পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহর হত্যাকারী চিহ্নিত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমেরিকায় একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ১৫ জুলাই নৃশংসভাবে খুন হওয়া তরুণ উদ্যোক্তা পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ ও দুই সপ্তাহ আগে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক উমাইর সালেহর হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কিত প্রবাসীরা। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। দুজনের হত্যাকারীকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারলেও নিউইয়র্ক পুলিশ ফাহিমের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাঁকে গ্রেফতার করা এখন সময়ের ব্যাপার বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইব্রাহীম চৌধুরী।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বড় ধরনের কোনো ব্যবসায়িক লেনদেনের জেরে ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়েছে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। তবে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং হত্যাকারী গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাবে না।

করোনা মহামারির বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসা নিউইয়র্কের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সঙ্গে নানা উৎকণ্ঠা তাড়া করছে লোকজনকে। বাংলাদেশি মা-বাবারা সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। নিজেরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

১৫ জুলাই ম্যানহাটনে নিজের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন ফাহিম সালেহ (৩৩)। নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অল্প বয়সে সারা বিশ্বের নজরে এসেছিলেন তিনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাঁর এগিয়ে যাওয়া অনুসরণ করতেন। ম্যানহাটনের সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারের অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন তিনি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও পুলিশ হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে পারেনি। নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু জানানো হয়েছে, ফাহিম সালেহকে খুন করা হয়েছে।

ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকসহ সব মহলের প্রতি তাঁদের এ কঠিন সময়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ১৬ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বা ফাহিমের বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পারিবারিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফাহিমের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আসা সংবাদ শিরোনাম এখনো আমাদের অনুধাবনের বাইরে। ফাহিম সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তিনি তার চেয়েও বেশি ছিলেন। ফাহিমকে মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল উল্লেখ করে পারিবারিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফাহিম খুব অল্প বয়সেই সাফল্য পেয়েছিলেন এবং অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি যাই করুন না কেন, বৃহত্তর ভালো এবং তাঁর পরিবারের কথা ভেবে তিনি তা করতেন।

সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও হয়ে প্রচারিত ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ড নিউইয়র্ক পুলিশের জন্য হাইপ্রোফাইল মামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বিষয় নিয়ে মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। ফাহিম সালেহকে খুন করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। পেশাদার খুনি শুরু থেকে বলা হলেও পেশাদার খুনি কাজটি পেশাদারের মতো শেষ করতে পারেননি। ফাহিম সালেহর সঙ্গে লিফটে ওঠা ব্যক্তিকে ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টেই ঢুকতে দেখা গেছে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা দিয়ে লিফটে করে নেমে আসার কোনো ভিডিও চিত্র পাওয়া যায়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাহিমের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় তাঁর এক প্রতিবেশী অস্বাভাবিক শব্দ শুনেছেন এবং ফাহিমের বোনকে তা ফোনে জানিয়েছেন বলে এখন জানা গেছে। হত্যার পর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ফাহিমের দেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ব্লিচ দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ নির্মাণকাজে ব্যবহার করা ভারী প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরানোর সময় লবি থেকে বা বাইরে থেকে কেউ ফাহিমের খোঁজ করতে আসেন। এ সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকারী তাঁর কাজ শেষ করতে পারেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনওইয়াইপিডির এসব তদন্তকাজের সঙ্গে জড়িত একজনের মতে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে দুটি লক্ষ্য থাকে। একটি হচ্ছে, মাফিয়া স্টাইলে অন্যদের ভয়াবহতার বার্তা দেওয়া। অন্যটি হচ্ছে, ব্যক্তিকে একদম শেষ করে দেয়া। শেষের যুক্তিটিই এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। হত্যাকারী ফাহিমের মরদেহ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভর্তি করে। এ ফাঁকে ধুয়ে মুছে রক্ত পরিষ্কার করে। ঘটনাস্থলে তেমন রক্ত পাওয়া যায়নি। কেউ আসছে বা দরজায় বেল দিচ্ছে, এমন ঘটনার পর হত্যাকারী সাত তলা অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। এ জন্য তাঁকে চাবি ব্যবহার করতে হয়েছে। ফলে এ ধরনের এক্সিট পরিকল্পনা আগে থেকেই নেয়া ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইলেকট্রিক করাতে ও অন্যত্র আঙুলের ছাপ পেয়েছে পুলিশ। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামলেও নিউইয়র্ক নগরী সর্বত্র এখন সিসি ক্যামেরার আওতায়। এসব ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও চিত্র দেখে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা গেছে। অনেকটা করোনাভাইরাসের কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মতো হত্যাকারীকে ধরে ফেলতে পারবে বলে নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে আভাস দেয়া হয়েছে। ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু খোয়া যায়নি। ঘরের মালামাল পরিপাটি ছিল। কোনো তছনছের চিহ্নও পায়নি পুলিশ। তাই শুরু থেকেই এ ঘটনা যে নিছক ডাকাতি, তা মনে করা হচ্ছে না।

নিহত ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে নিউইয়র্ক পুলিশের কাছে এ অপরাধের তদন্তের গভীরে যাওয়া এবং ফাহিমের হত্যাকারীর বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

তদন্তের কোনো হালানাগাদ বিবরণী না পাওয়া গেলেও নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের এ হত্যাকাণ্ড বিমর্ষ করে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি তরুণদের কাছে ফাহিম সালেহ রোল মডেল হয়ে উঠেছিলেন। অনেকেই নিউইয়র্কের ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন। অনেকে বলছেন, ফাহিম সালেহর মতো খ্যাতিমান এক তরুণের হত্যাকাণ্ডের পরও নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটি সমন্বিতভাবে তাদের ক্ষোভটাও দেখাতে পারেনি। প্রতিদিন নানা সভা-সমিতি করলেও বাংলাদেশি কোনো নাগরিক সংগঠককে এ নিয়ে প্রতিবাদী বা ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়নি।

ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে করোনা বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানো নিউইয়র্কের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। গুলি হচ্ছে নগরীর এখানে-ওখানে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ নগরী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কের পরিস্থিতি করোনা বিপর্যয়ের পরই যেন পাল্টে গেছে। গত সপ্তাহান্তে নগরীতে ৫৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এর আগে ফোর্থ জুলাই সপ্তাহান্তে এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছে ৬৪ জন। ১২ জুলাই পর্যন্ত নগরীতে ৬৬৪টি গুলির ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে নিউইয়র্কের জার্সিসিটি সংলগ্ন এলাকায় হাডসন নদী থেকে ৪ জুলাই দুটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান তরুণ। তাঁর নাম উমাইর সালেহ (২৩)। উমাইর সালেহ বাংলাদেশি-আমেরিকান। নিউজার্সির স্টেট ইউনিভার্সিটি রাটগার্টস থেকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ এ বছরই গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন মেধাবী উমাইর। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। প্রায় একই সময়ে নদীতে ২২ বছরের এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দুই সপ্তাহ পার হলেও উমাইর সালেহর হত্যাকারী গ্রেফতার হয়নি।

নিহত উমাইর সাহলের স্কুল শিক্ষিকা মা জানিয়েছিলেন, উমাইর বিকেলে হাঁটতে যাচ্ছে বলে বাসা থেকে বেরিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ছিল না।

নগরীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করেন এমন লোকজনের মতে, কয়েকটি কারণকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে নগরীর অপরাধ এমনিতেই বেড়ে যায়। লোকজন বাইরে থাকে। পার্ক, ব্যাকইয়ার্ড সর্বত্র পার্টি থাকে। সড়ক জনপদের উন্মুক্ত কোলাহলে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

নগরীর মেয়র বিল ডি ব্লাজিও মনে করেন, অর্থনৈতিক দুর্দশা, মহামারি পরবর্তী সংকট এবং বন্দুক সহিংসতার ইন্ধনদাতারা বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নগরীর পুলিশ কমিশনার ডারমট শিয়া বলেছেন, মহামারির কারণে নিউইয়র্কের কারাগার থেকে বহু অপরাধীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের জন্য নতুন আইন, নাগরিক আন্দোলনের পর পুলিশের নিষ্ঠুরতা রোধে সংস্কার আনার নানা পদক্ষেপও এর জন্য দায়ী বলে তিনি মনে করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067381858825684