পাঠ্য বিষয় ও শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবা দরকার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আধুনিক বিশ্বের সব দেশেই ১৭-১৮ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ—এই তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বলতে উচ্চশিক্ষাপূর্ব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর—দুটোর মিলিত রূপকে বোঝায়। বিভিন্ন দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের নিম্ন, মধ্য বা উচ্চ উপস্তর থেকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক/কারিগরি শিক্ষাধারা প্রচলিত। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা মাধ্যমিকের মধ্য উপস্তর (নবম-দশম শ্রেণি) থেকে শুরু হয়। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়ন সাধারণত ১০–১২ বছরের ব্যবধানে করা হয়। বাংলাদেশে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭২-৭৪) রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথমবার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের (১৯৭৬- ৮০) পর তা দুবার (১৯৯১-৯৫ ও ২০১২) পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও বাস্তবায়নের মধ্যে ১৫-১৬ বছর এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় আবর্তনের মধ্যে ১৬-১৭ বছরের ব্যবধান ছিল। কিন্তু তৃতীয় আবর্তনের (২০১১-১৩) মাত্র আট বছর পর চতুর্থবারের মতো শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ শুরু হয়েছে। এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য: ১. জাতিসংঘ–ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (২০১৬-২০৩০) বিধৃত শিক্ষার লক্ষ্যগুলো (এসডিজি-৪) অর্জনের চেষ্টা এবং ২. বিশ্বব্যাপী স্কুলশিক্ষাকে যোগ্যতাভিত্তিক করার ঢেউকে ধারণ করা।

প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতিপর্বে শিশু শ্রেণি, প্লে-গ্রুপ, কেজি-১ ও ২ ইত্যাদি সব সময়ই প্রচলিত। কিন্তু এর কোনোটাই এতকাল জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রথমবারের মতো দুই বছরের প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়ভাবে প্রবর্তনের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২’-তে এক বছরের প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়, যা ২০১৫ সাল থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এবার কি প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা দুই বছরের করা যাবে? মনে রাখা দরকার, যেকোনো পরিকল্পনায় বাস্তবায়নক্ষেত্রের সামর্থ্য বিবেচনায় নিতে হয়। সামর্থ্য ও প্রস্তুতির অভাবে অনেক উত্তম পরিকল্পনাও ভেস্তে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা এখনো মাত্র তিনটি করে। এসব স্কুলের এক বছরের প্রাক্‌-প্রাথমিক (অস্ট্রেলিয়ার ‘জিরো ইয়ার’ অনুসরণে একে ‘শূন্য শ্রেণি’ নাম দেওয়া যায়) থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠের ব্যবস্থা দুই শিফটে করা হয়। সব স্কুলে অন্তত চারটি শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত দুই শ্রেণির প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা যাবে না।

চলমান প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে সব শ্রেণিতেই আট-নয়টি শিখনক্ষেত্র বা বিষয় নির্ধারিত আছে। এগুলো হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্ম, পরিবেশ (প্রাকৃতিক ও সামাজিক), শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং সংগীত। প্রতিটি শিখনক্ষেত্রের জন্য পৃথক শিক্ষক নির্দেশিকাও রয়েছে। কিন্তু বিস্তৃত এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার পাঠ্যপুস্তক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য মাত্র তিনটি (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) করে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে হঠাৎ পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা বেড়ে হয় ছয়টি। সেখানে আগের তিনটির সঙ্গে ধর্ম, বিজ্ঞান এবং ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বিষয়গুলো পাঠ্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শুধু শিক্ষক নির্দেশিকা দিয়ে যেসব বিষয় অনুশীলনের কথা, সেগুলোতে শিক্ষাক্রমের অভিপ্রায় (ইনটেনশন) কতটা পূরণ হয়, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে; বিষয়টি প্রধানত শিক্ষকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা যেটুকু বাংলা ‘ভাষা’ শেখে, তা দিয়ে সহজেই বাংলায় লিখিত পরিবেশ–সম্পর্কিত ‘ভাব’ নিয়ে একটি সমন্বিত পাঠ্যপুস্তক দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য করা যায়। তাতে দুটি প্রধান কাজ হয়। ১. শিক্ষাক্রমের নিচ থেকে ওপরের শ্রেণিতে বিষয়বস্তুর ক্রমশ বৃদ্ধির নীতি (কনসেন্ট্রিক বা স্পাইরাল মেথড) অনুসৃত হয়, ২. শিক্ষার্থীদের পরিবেশ শিক্ষার জন্য শিক্ষকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না।

মাধ্যমিক স্তরের (নবম-দশম শ্রেণি) সাধারণ শিক্ষা ১৯৬৩ সাল থেকে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসা শিক্ষা ইত্যাদি ধারায় বিভক্ত। ২০০৪-২০০৫ সালে নবম-দশম শ্রেণিতে শাখা বিভাজন বর্জন করে ‘একমুখী’ শিক্ষা প্রবর্তনের যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। জানা যায়, পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণিতে পুনরায় শাখাবিহীন এক ধারার শিক্ষা প্রবর্তনের পরিকল্পনা রয়েছে। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২’-এর আওতায় ১২টি পত্রের পাঠ এবং ১২০০ (+ ১০০) নম্বরের এসএসসি পরীক্ষা চলার পর আশা করা যায়, পাঠ্যবিষয়ের সুবিবেচিত সমাবেশ ঘটাতে পারলে এক ধারার মাধ্যমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা যাবে।

শাখাবিহীন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে এমনভাবে বিষয় নির্বাচন করতে হবে, যাতে উচ্চশিক্ষাস্তরে যেকোনো শাখা ও বিষয় পড়ার মজবুত ভিত তৈরি হয়। এর জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত (একক), ধর্ম এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মতো ‘কোর’ বিষয়গুলো ছাড়াও বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষা—প্রতিটি ধারার এক/একাধিক বিষয়ের সমাহার ঘটানো প্রয়োজন। বিজ্ঞানের ভিত মজবুত করার জন্য ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান নামে দুটি পত্রের ব্যবস্থা থাকতে পারে। পরিবেশ শিক্ষার মূল বিষয়গুলো ভৌত ও জীব উভয় বিজ্ঞানে এবং শারীরিক শিক্ষার জীব বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো জীববিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত করলে পরিবেশ শিক্ষা বা শারীরিক শিক্ষার কোনোটার জন্যই পৃথক পাঠ্য বিষয় দরকার হবে না। বিশ্ব নাগরিকত্ব ও উচ্চতর মানববিদ্যার ভিত রচনার জন্য কোন রাজা কত সালে কী করেছিলেন ধরনের ‘রাজাদের ইতিহাসের’ পরিবর্তে দরকার বিশ্বসভ্যতার (বাংলাদেশসহ) ইতিহাস-সংবলিত (যাতে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ভিত তৈরি হয়) একটি পত্র এবং পৌরনীতি ও অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটি পত্র। ব্যবসায় শিক্ষার ভিত তৈরির জন্য হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে যে পত্রটি পাঠ্য হতে পারে, তাকে কৃষিশিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ও নতুন পাঠ্য প্রকৌশল শিক্ষার মতো বৃত্তিমূলক বিষয়ের মধ্যে একটির অপশন থাকলে পত্রের মোট সংখ্যা (ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া) ১২টির মধ্যে সীমিত রাখা যাবে। উচ্চমাধ্যমিক উপস্তরের পাঠ্যবিষয় বর্তমানের মতোই থাকতে পারে।

আদর্শ প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন স্তর থেকে ধাপে ধাপে ওপরের শ্রেণিতে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম এভাবে একটি করে ওপরের শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করতে ১২-১৩ বছর সময় লেগে যায়। তাই পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম এবং পুরোনো শিক্ষাক্রমের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য না থাকলে শিক্ষাক্রম কয়েক শ্রেণিতে একসঙ্গেও বাস্তবায়ন করা যায়। কিন্তু অনেকগুলো শ্রেণির শিক্ষাক্রম একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে গেলে তাড়াহুড়ো করে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হয়। এভাবে রচিত পাঠ্যপুস্তকের মান ভালো হয় না (জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ বাস্তবায়নে একসঙ্গে নয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে গিয়ে তেমনটাই হয়েছিল); পরে শত কেঁচে গণ্ডূষ করেও ঈপ্সিত মানে উন্নীত করা সম্ভব হয় না।

একই শিক্ষাস্তরে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অবশ্যই সর্বনিম্ন শ্রেণি থেকে শুরু করতে হয়। দেশে প্রাক্‌-প্রাথমিক বা ‘শূন্য শ্রেণি’কে জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করায় এখন প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন ‘শূন্য শ্রেণি’ থেকেই শুরু করতে হবে, প্রথম/দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে বাস্তবায়ন শুরু করা হবে অযৌক্তিক। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক উপস্তরের কাঠামো বেশ একটু ভিন্ন হওয়ায় একসঙ্গে ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা অযৌক্তিক হবে না।

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015285015106201