পানিবন্দি ৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘আমাদের প্রতিটি বাড়িতে বন্যার পানি, তাই স্কুলে এসে পড়ালেখার পাশাপাশি শুকনো জায়গায় থাকতে পারতাম। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে আমাদের স্কুলে পানি উঠে গেল। তাই স্যারেরা আমাদের স্কুল বন্ধ করে দিছে। এখন থ্যাইক্যা আংগরে বাড়ি ঘরের মাচায় উঠে বসে বসে দিন কাটাতে হবে।’

বৃহস্পতিবার বন্যাদুর্গত জামালপুরের ইসলামপুর বলিয়াদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল খালেক, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রহিমা বেগম এবং ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহেল রানা এভাবেই তাদের স্কুল বন্ধের কথা জানিয়েছে। জামালপুরসহ দেশের ৯ জেলায় প্রবল বন্যার কারণে কমপক্ষে তিন হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ থাকার খবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। পানির তোড়ে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত এক ডজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো কিছু স্কুল-মাদরাসা। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেজি ওয়ান থেকে শুরু করে ডিগ্রি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এদিকে এই পরিস্থিতিতে গত ২ জুলাই থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুরু হওয়া বিএ (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা স্থগিতের জন্য মানবিক দাবি জানিয়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার শিক্ষার্থীরা।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, প্রবল বন্যায় জেলার ১০১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে প্রায় দেড়লাখ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পডেছে। জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় নার্সারি-কেজি ওয়ান থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৫৯টি। তার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত বন্যাপ্লাবিত হয়ে বন্ধ রয়েছে ৭০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ৬৬৯টি। তার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৩১০টি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, মাঠে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় জেলার সাত উপজেলার ৩৬৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৮১টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৮৪টি ও কলেজ ৪টি। আবার চারটি সরকারি প্রাথমিক এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন ইতোমধ্যে ভাঙনে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো হোসেন আলী বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যায় জেলা শহরসহ ৫ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ পানিতে ভাসছে। মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। ফুলছড়ির ঘোলদহ গ্রামের রাশেদুল ইসলাম নামে এক বিএ পরীক্ষার্থী জানান, ‘ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত। বইপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। সদরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিয়েছি। এ অবস্থা আমার মতো আরও অনেক বিএ পরীক্ষার্থীর। এ কারণে চলমান পরীক্ষাটি স্থগিত করলে আমাদের জন্য ভালো হতো।’

সিলেট অফিস জানায়, বন্যাজনিত কারণে সিলেট বিভাগের চার জেলায় ৬ শতাধিক মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক ও প্রাইমারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৪৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। শুধুমাত্র জগন্নাথপুর উপজেলায় ৫৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেট জেলায় ১৯৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, এবার বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় মোট ৫ হাজার ৪৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮১৯ টি বিদ্যালয় প্লাবিত হয়। এর মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ৪৯৩টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামছে। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে পাঠদান শুরু করা হবে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি সামান্যহারে কমতে শুরু করলেও তীব্র ভাঙনের মুখে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলার ২৮৫ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাশ রুমে, মাঠে ও চলাচলের রাস্তায় পানি ওঠায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ১৩২টি মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে পানি উঠেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ ৫ থেকে ৭ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। পানির তীব্র স্রোতের মুখে ভেঙে গেছে নাগেশ্বরী উপজেলার শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নাগেশ্বরী এলাহীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম জানান, অনেক স্কুল ডুবে যাওয়াসহ রাস্তা তলিয়ে থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। যেসব স্কুল ডুবে যায়নি সেগুলো আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে মোট ২১৫ টি প্রাথমিক ও ৬৭ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা চরম বিপাকে পড়েছে। এছাড়া ৬টি স্কুল যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এগুলো হলো: চৌহালি উপজেলার অ্যাওয়াজী কাঠালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিদাশুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবারিয়া পূর্ব পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলজলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেলকুচি উপজেলার রতনকান্দি সোহাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বেতুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

কাজিপুরের নাটুয়ারপাড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বকুল সরকার জানান, ‘বন্যার কারণে কলেজ এক সপ্তাহের ছুটি দেয়া হয়েছে। কারণ শিক্ষার্থী কলেজে আসতে পারছে না।’ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন জানান, ‘বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।’

বগুড়া ষ্টাফ রিপোর্টার জানান, বন্যার কারণে জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিকল্প উপায়ে পাঠদান করানো হচ্ছে।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, আর মাত্র চারমাস পরই শুরু হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষা। চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য এ সময়টাতেই শিক্ষার্থীদের বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা। কিন্তু যমুনার স্রোত তাদের না যেতে দিচ্ছে বিদ্যালয়ে, না পড়তে দিচ্ছে বাড়িতে। এমন দুর্যোগ নেমে আসায় শঙ্কিত তাদের অভিভাবকরাও।

শিক্ষা বিভাগের হিসেব অনুযায়ী যমুনা নদী বেষ্টিত এই তিন উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলায়। এই উপজেলায় ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041580200195312