পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাস: সাত সমস্যা বনাম তিন সমাধান

আহসান কবির |

দৈনিক শিক্ষায় লিখেছিলাম-অটোপাসের সনদ পাওয়ার চেয়ে বয়ে বেড়ানো কঠিন হবে। এটা নিয়ে আজীবন ‘অটোপাসওয়ালাদের’ যে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক হাঙ্গামা পোহাতে হবে সেটা বয়ে বেড়ানোর মতো ক্ষমতা কী  সবার আছে? আগের লেখার মতো শুরুতেই কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক।

এক. 
যারা এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন তারা কী অটোপাসের বাইরে থাকবেন, মানে তারা কী ফেল বা অকৃতকার্যই থেকে যাবেন? টেস্ট পরীক্ষায় যারা ফেল করেছিলেন তাদের এইচএসসির ফাইনাল পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে দেয়া হয়নি। যারা অটোপাসের আওতায় আসবেন তাদের ফল নির্নীত হবে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে। যারা এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নি তারাও কিন্তু জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। তাহলে? যারা এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষাতে অকৃতকার্য হয়েছিলেন তারা যদি আইনের দ্বারস্থ তখন কী হবে? যদিও যারা টেস্টে ফেল করেছিলেন তাদের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সংসারের অচলাবস্থা কিংবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনেক পরীক্ষার্থী টেস্ট পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হতে পারেন নি। সংগত কারণে যদি কেউ এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নেন তাহলে রাষ্ট্র কী এদের পাশে দাঁড়াবে? নাকি করোনাবান্ধব অটোপাসের কালেও যারা পাস করতে পারে নি তাদের সীমাহীন ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মুখোমুখি হতে হবে?

দুই.
অটোপাস করবেন এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৫৯ জন। এরা পরীক্ষার জন্য ফি দিয়েছিলেন। কতো টাকা জমা আছে সরকারের কাছে? সরকার টাকা নিয়েও করোনার কারণে পরীক্ষা নিতে পারে নি। তাহলে এই টাকা কী ফেরত পাবে শিক্ষার্থীরা? না পেলে যদি কেউ আইনের দ্বারস্থ হন তখন কী হবে?

তিন.
যারা ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষা দেন নি বা বিভিন্ন কারণে দিতে পারেন নি, যারা অনিয়মিত পরীক্ষার্থী এবং যারা এক ও দুই বিষয়ে ফেল করেছিলেন এদের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। কোন বিবেচনায় এদের পাস করানো হবে? শুধু ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের পরীক্ষার্থী  হিসেবে? যারা পরীক্ষা দেন নি এবং ২০১৯ এর এক ও দুই বিষয়ের ফেল করেছিলেন তারা যাদুমন্ত্র বলে এবার পাস করে যাবেন!

চার.
যারা ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট ছিলেন না তারা নিজেদের মানোন্নয়নের জন্য পুনরায় পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোন বিবেচনায় এবার তাদের মান উন্নয়ন করানো হবে? যদি এদের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল তুলনামূলক খারাপ হয়ে থাকে তাহলে কী তাদের মানের উন্নতির পরিবর্তে ফল আরও খারাপ করিয়ে দেয়া হবে? যদি মানের উন্নতি না পেয়ে কেউ আইনের দ্বারস্থ হন তখন কী হবে?

পাঁচ.
যারা বিভাগ পরিবর্তন করেছিলেন অর্থাৎ বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা বিজ্ঞান থেকে ব্যবসা বাণিজ্যে এসেছিলেন তাদের কোন বিচার বা বিবেচনায় পাস করানো হবে? 

ছয়.
এবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির প্রক্রিয়া কেমন হবে? অটোপাসওয়ালাদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে? আগের মতো একই প্রক্রিয়ায়? সেখানে ২০১৯ এর অনিয়মিত,এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কীভাবে হবে?

সাত.
‘অটোপাসের’ পুরো ব্যাপারটা এখনও গোলমেলে যার কোন পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় নি সরকারের কাছ থেকে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের অটোপাসের ব্যাপারটার পক্ষে যুক্তি একটাই! এই অটোপাস ‘করোনা বান্ধব’! পৃথিবীর অন্ততঃ পাঁচটি দেশের উদাহরণ কী কেউ দিতে পারবেন যেখানে পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করে অটোপাস করিয়ে দেয়া হয়েছে?

পৃথিবীতে পরীক্ষা নেয়ার বিকল্প কোন পদ্ধতি আজও আবিষ্কৃত হয় নি। রাজধানীর একটি স্বনামধন্য কলেজের অধ্যক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের (সম্মান) পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু তার সনদে পাসের সন লেখা ১৯৯৩। রাজনৈতিক ডামাডোলে পরীক্ষা নিতে এত দেরি হয়েছিলো। এমন হাজারো উদাহরণ আছে। সূতরাং এখনও সময় চলে যায় নি। সস্তা জনপ্রিয়তার কারণে উচ্চমাধ্যমিক এই অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কিনা জানি না। সারাদেশে সমানে চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা চলছে।  পরীক্ষাবিহীন অটোপাসের মাধ্যমে ১৩-১৪ লাখ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। পরীক্ষা খুব ভালোভাবে নেয়া সম্ভব। যেমন-

এক.
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। সরকারি ও বেসরকারি একাধিক স্কুল রয়েছে গ্রাম, উপ-শহর বা শহরে রয়েছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় স্থাপনা ও পরীক্ষা নেয়ার সব আসবাব রয়েছে কলেজ ও স্কুলগুলোতে। এখন পরীক্ষা নেয়ার সার্বিক ব্যবস্থাপনা দরকার। একমাসের পরীক্ষা প্রয়োজনে দুইমাসে নেয়া হোক। আগে একরুমে যতজন পরীক্ষার্থী অংশ নিতেন প্রয়োজনে তার তিনভাগের একভাগকে একরুমে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হোক।তবে যে কোন পরীক্ষা সারাদেশে একই সময়ে নিলে ভালো হয়। 

দুই.
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজের (প্রয়োজনে কমিউনিটি সেন্টার বা উপজেলা কমপ্লেক্সের কোন ভবন) ভবনগুলোকে স্যানিটাইজেশন করা সম্ভব সহজেই। সহজেই সম্ভব পরীক্ষার খাতা,প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামকে স্যানিটাইজ করে করোনার ঝুকিমুক্ত রাখা। কলেজের শিক্ষকদের পরীক্ষা নেয়ার কাজে অর্থাৎ পরীক্ষক হিসেবে নেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে অন্যান্য মাধ্যমের শিক্ষকদেরও পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যারা পরীক্ষা নেবেন এবং যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবেন তারা মাস্ক পরে আসবেন। পরীক্ষাকেন্দ্রে তাদের স্যানিটাইজ করে হলে ঢোকানো হলে করোনার ঝুকি থাকবে না বললেই চলে।

তিন.
প্রয়োজনে পরীক্ষার ঘোষণা,পরীক্ষার সময়সূচি দিয়ে ডিসেম্বর থেকে এই পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল,কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার আপাতঃ পরিকল্পনা আছে বলেই শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একমাস আগে থেকে পরীক্ষা না নেয়ার কোন যুক্তি নেই।

করোনার জন্য শুধু স্কুল কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ আছে। এছাড়া সব কিছুই চলছে আগের নিয়মে গার্মেন্টসসহ সব শিল্পকারখানা খুলেছে। বাদুরঝোলা হয়ে উপচে পড়া মানুষ লঞ্চ,ফেরি, বাসও ট্রেনে চড়ছে। পণ্য পরিবহনের জন্য নৌযান ও ট্রাক চলছে। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরার ক্ষেত্রে শিথিলতা লক্ষ করা গেছে। অফিস আদালতে মানুষের কমতি নেই। এই অবস্থার মধ্যে সরকার জাতীয় সংসদের অন্ততঃ তিনটি আসনের উপ নির্বাচনের আয়োজন করেছে। আয়োজন করা হয় নি শুধু এইচএসসি পরীক্ষার! 

‘অটোপাসের’ ঘোষণা রদ করে সরকার এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে এই কামনা করি।

লেখক : আহসান কবির, সাংবাদিক, অভিনেতা ও রম্যলেখক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030510425567627