বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার জন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা প্রথমেই যান সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও তথ্যের প্রাথমিক উৎস হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। মোদ্দা কথা, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি, গবেষণা, প্রকাশনাসহ এ-সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের একেবারে প্রাথমিক ও নির্ভরযোগ্য সূত্র হলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটিরই এখন নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। নিয়মিত হালনাগাদ না করায় বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠতে পারেনি এসব ওয়েবসাইট। এর ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন প্রয়োজনীয় তথ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি বিভিন্ন র্যাংকিংয়েও পিছিয়ে পড়ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শনিবার (০১ জুন) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বিভিন্ন ক্যাটাগরির বর্ণনায় শুধু নাম লিখে রাখা হয়েছে। কোনোটিতে যুক্ত করা হয়েছে কেবল কয়েক লাইন তথ্য। আবাসিক হলগুলোর পেজে হলের বিবরণও অসম্পূর্ণ। অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য পৃথক পেজ রাখা হলেও তাতে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পেজগুলোয় এগুলোর কার্যক্রম ও কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নামের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও নেই এসব ওয়েবসাইটে।
দেশের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টির আইসিটি সেল সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এডুকস কোম্পানি থেকে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডোমেইন http://www.univdhaka.edu ক্রয় করা হয়। এর কয়েকটি সাবডোমেইন তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ওয়েবসাইট পরিচালনা করা হয়। এরপর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে তৈরি করা হয় বর্তমান ডোমেইন http://www.du.ac.bd। এরপর এক দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যের অনুপস্থিতি রয়েছে ওয়েবসাইটটিতে। ওয়েবসাইটের রিসার্চ সেকশনে দেখা যায়, তিন বছর আগে আপলোড করা ফাইলকে ‘কারেন্ট রিসার্চ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ গবেষণাই সম্পন্ন হয়েছে আরও আগে। নিয়মিত হালনাগাদ না করায় অনেক পুরনো গবেষণা প্রকল্পকে দেখানো হচ্ছে চলমান প্রকল্প হিসেবে। এছাড়া বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য সুস্পষ্ট কোনো ভর্তি নির্দেশনাও নেই ওয়েবসাইটটিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবির আইসিটি সেলের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান বলেন, আইসিটি সেল হয়েছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর আগে প্রোভিসি অফিসের অধীনে একজন প্রোগ্রামার দিয়েই সব কাজ করানো হতো। এখন আমরা চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটকে কীভাবে আন্তর্জাতিক মানে রূপ দেয়া যায়। অনেক সময় বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো তথ্য দিতে বিলম্ব করায় হালনাগাদ করা সম্ভব হয় না। রিসার্চ ওয়ার্কের আপডেট তথ্য চেয়ে সব শিক্ষককে চিঠি দেয়া হয়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে সবাইকে এ তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর আমরা সেটি হালনাগাদ করব। আর বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্যও একটি নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই সেটি আপলোড করা হবে।
দেশের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্যাটাগরিরই অনুপস্থিতি রয়েছে এতে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণাসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। যদিও বিশ্বের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গবেষণাকে প্রধান তিনটি ক্যাটাগরির অন্যতম হিসেবে দেখানো হয়। এছাড়া পাবলিকেশনস ক্যাটাগরিতে ক্লিক করলে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের অ্যানুয়াল রিপোর্ট লেখা একটি লিংক পাওয়া যায়। এ লিংকে ক্লিক করে কোনো ফাইল বা পেজ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি যেসব তথ্য রয়েছে, সেগুলোও নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। ওয়েবসাইটটি হালনাগাদ না করার কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য খুঁজতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, ইনস্টিটিউট ও বিভাগের প্রয়োজনীয় তথ্য ওয়েবসাইটটিতে নেই বলে অভিযোগ রাবি শিক্ষার্থীদের। রাবির মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী তারেক হাসান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করে তার ওয়েবসাইট। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডসহ স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকলে তাদের সব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে আমাদের কোনো আইডেনটিটি নেই।
তথৈবচ দশা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটিরও। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষণা, প্রকাশনা, জার্নালসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না ওয়েবসাইটটিতে। অনুষদ, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের নাম দিয়ে পেজ খুলেই দায় সারা। কিন্তু এসব পেজে বিস্তারিত কোনো তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক হানিফ সিদ্দিকী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদের উদ্যোগ কয়েক দফায় নেয়া হলেও তা সফল হয়নি। বিভাগ ও ইনস্টিটিউট থেকে তথ্য চেয়েও তা পাওয়া যায়নি। তাই এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আলাদা প্রোফাইল করে সবাইকে স্বতন্ত্র ইউজার আইডি দেয়া হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে নিজের প্রোফাইল আপডেট করে নেবে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে তিনটি বিভাগে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্যাটাগরিতেও তথ্য আপলোড ও হালনাগাদের কাজ চলছে। আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা একটি সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট দেখতে পাব।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষকের তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্যপ্রযুক্তি সেবা নিয়ে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. জাভেদ ইকবাল খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো প্রয়োজন। এজন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই আন্তর্জাতিক মানের একটি ওয়েবসাইট থাকা জরুরি। শুধু ওয়েবসাইট থাকলেই হবে না, সেখানে শিক্ষা ও গবেষণাসংশ্লিষ্ট নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত আপলোড করতে হবে। পাশাপাশি এসব তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। এছাড়া তথ্যের অভাবে অনেক সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়েও পিছিয়ে থাকতে হয়।