পুরুষ : কন্যা শিশুর কাছে ভয়ংকর, অভিভাবকের কাছে ধর্ষক!

পলাশ রায় |

নারী শিক্ষার জন্য আমার জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সঙ্গত কারণেই নামটা উল্লেখ করলাম না। মাস তিনেক আগে সেখানকার এক নারী শিক্ষক আমাকে ফোন করে বলেন, দাদা কাল আপনাকে আমাদের স্কুলে একটু আসাটা বিশেষ দরকার; মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ হবে। বললাম, ঠিক আছে আপা ক্যামেরাম্যানকে পাঠাবো। না দাদা আপনার নিউজ করা লাগবে না। আপনাকেই একটু থাকতে হবে, বলেন ওই শিক্ষক। হেসে বললাম, কেন আপা আমি তো মার্শাল আর্ট জানি না? উত্তরে তিনি বলেন, এই স্কুলে ক’জন মৌলবাদী শিক্ষক রয়েছেন, রয়েছেন অনেক অভিভাবকও, তাই আপনার উপস্থিতি খুব জরুরি।

বাস্তবেও তাই ঘটলো। বরিশালের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে ছাত্রীদের মার্শাল আর্ট শেখাতে আসে তখন ক’জন শিক্ষক এবং অভিভাবক বাধা দেয়। অযুহাত তোলেন প্রশিক্ষক তো পুরুষ, তাদের কাছে মেয়েরা মার্শাল-আর্ট শিখবে কেন? আমি একটু পরে উপস্থিত হই। ততক্ষণে ওই নারী শিক্ষক একাই মৌলবাদী চক্রের সাথে লড়াই করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরে আমি গিয়ে ক’জন অভিভাবককে আশ্বস্ত করে বলি, আমরা কমপক্ষে তিনজন ছাত্রীকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করব। পরে তারাই সব মেয়েদের শিখিয়ে দেবে। আপাতত ওই পুরুষ প্রশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ চলুক।

আসলে এ গল্পটা এই লেখার প্রধান বিষয় নয়; লিখতে গিয়ে চলে এলো মাত্র। এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। সব মিটমাট করে ভাবলাম এবার একটু নিউজ করি। ‘যৌন নিপিড়ন রুখবে মার্শাল আর্ট’ শিরোনামটা মনে মনে ঠিক করলাম। কিন্তু সাক্ষাৎকার নেয়ার শুরুতেই আমি থমকে গেলাম। ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী ক্ষিপ্ত ভাষায় বলে ওঠে ‘আমি মার্শাল আর্ট শিখে ছেলেদের মারবো।’

মারতে হবে কেন মা? এমন প্রশ্ন করলে শিশুটি বলে ‘আপনি তো সাংবাদিক, টিভিতে-পত্রিকায় দেখেন না মেয়েদের কীভাবে নির্যাতন করা হয়? আমি মার্শাল আর্ট শিখে এক একটাকে ধরে ধরে বদলা নেবো।’ আমি শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুই বলতে পারিনি। পুরুষ মানুষ হওয়ার অপরাধে ওই কন্যা শিশুটি যদি আমাকেও মারতে চাইতো তাহলেও আমার কিছু করার ছিল না।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর উদ্ধৃতি দিয়ে সম্প্রতি বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯টি শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ মোট ১৬ জন শিশু মারা গেছে। অন্তত ৪৭ জন মেয়ে শিশু ও ২ জন ছেলে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩৫৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গিয়েছিল ২২ জন এবং আহত হয়েছিল ৩৩৪ জন।

সর্বশেষ গত ৫ জুলাই শিশু ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মা (৭) ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী সব মানুষকেই শোকাহত করে। বিশেষ করে কন্যা শিশুর অভিভাবক মহলে। আমার এ লেখায় আবারও এক বাস্তব গল্পের কথোপকথন দিয়ে শেষ করব।

সোমবার (৮ জুলাই) স্কুল শিক্ষক চাচাতো বোন তার ৬ বছরে কন্যা শিশুটি নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানে আমার বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। দেখেই আমি বলি, কিরে মামনিকে কি তোর স্কুলে ভর্তি করেছিস নাকি? ও বলে, নারে দাদা, শ্বাশুড়ি গ্রামে গেছেন। আসতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে। তাই ওর স্কুল ছুটির পর আমার সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছি। আমি বলি, কেন তোর প্রতিবেশী মামনির বান্ধবী মিথিলাদের (মিথিলা ছদ্মনাম) বাড়িতেই এ ঘণ্টার জন্য রাখতে পারতিস। জবাবে আমার স্কুল শিক্ষক বোন বলে, না এখন আর সে ভরসা পাই না। মিথিলার বাবা, চাচা আর দাদু রয়েছেন। আশপাশে আরও ছেলে-পুলে রয়েছে, তুই সাংবাদিক তোকে আর বলতে হবে না।

আসলেই আমাকে এ বিষয়ে কোনো মা কিংবা অভিভাবককে আর আমাকে বলতে হবে না। আমি বুঝে গেছি, পুরুষ বলতে অবুঝ কন্যা শিশুরা এখন থেকে এক ভয়ংকর প্রাণিকে চিনবে আর তার মা-বাবা জানবে ধর্ষক হিসেবে।

লেখক: পলাশ রায়, সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034811496734619