শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয় বরং একটি নেশা। এই নেশা যাদের আকৃষ্ট করেছে তারা শত বঞ্চনা সত্ত্বেও আর শিক্ষকতা পেশা ছাড়তে পারেনি। শিক্ষকতা পেশার মধ্যে আবার প্রাথমিক শিক্ষকতা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। কারণ জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছোট্ট কোমলমতী শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষকদেরই কাঁধে। প্রাথমিক শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালনে সফল হলে পুরো জাতি সফল হবে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যর্থতায় পুরো জাতি ব্যর্থ হবে।
আরও দেখুন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন শুরু হলো যেভাবে (ভিডিও)
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিযুক্ত থাকার পরেও আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো বেতন ও পদমর্যাদায় সবচেয়ে অবহেলিত। আজকে যারা বড় বড় পদে বসে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা সকলেই একসময় এই প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিলেন। তারপরও তাদের কি একবারও প্রাথমিক শিক্ষকদের মমতা ও ভালোবাসার কথা মনে পড়ে না? যদি সত্যিই মনে পড়তো তাহলে আধুনিক এই যুগেও প্রাথমিক শিক্ষকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এত অবহেলিত অবস্থায় থাকতো না।
আমাদের দেশে নীতিনির্ধারকসহ অনেকে বলে থাকেন শিক্ষকদের মর্যাদা টাকা দিয়ে বিচার করা যায় না, শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে। তর্কের খাতিরে এই কথাটি সত্য হলেও আমাদের দেশে শিক্ষকদের অবহেলিত করে রাখার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে এই কথাটি। যেসব দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি যেমন চীন, জাপান, সিংগাপুর, ফিনল্যান্ড, সেসব দেশে শিক্ষকদের বেতন অন্য যে কোনো পেশার থেকে বেশি। সেইসব দেশেতো আমাদের দেশের মতো শিক্ষকদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি বলে সভা-সেমিনারে চিৎকার করতে হয় না। কারণ সেইসব দেশের নীতিনির্ধারকরা শুধু মুখে নয় বাস্তবে বেতনসহ সকল ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন। শিক্ষকদের মর্যাদা টাকা দিয়ে বিচার করা যায় না কথাটির মানে এই নয় যে শিক্ষকদের এমন নিম্ন বেতন গ্রেড দিতে হবে, যেন শিক্ষকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শিক্ষকরাও মানুষ, তাদের পরিবার আছে, তাদেরকেও সমাজে চলতে হয়। আপনি যে বাজারে যে দ্রব্যসামগ্রী কিনেন সেই বাজারে শিক্ষকদেরও একই দামে দ্রব্যসামগ্রী কিনতে হয়। শিক্ষকদের জন্য আলাদা এমন কোনো বাজার নেই যেখানে মর্যাদা দিয়ে শিক্ষক তার ও তার পরিবারের জন্য দ্রব্যসামগ্রী কিনবেন। তাহলে কীভাবে বলেন যে টাকা দিয়ে শিক্ষকের মর্যাদা বিচার করা যায় না?
আমাদের দেশে এমন হাজার হাজার আদর্শ শিক্ষক আছেন যারা সারাজীবন শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে পরিশ্রম করে মোমবাতির মতো নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন, কিন্তু শেষ বয়সে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন। কোনোদিন কোনো শিক্ষার্থী অথবা রাষ্ট্র একবারও এই মানুষ গড়ার কারিগরদের কোনো খোঁজও নেয়নি। তাহলে শিক্ষকদের কোন মর্যাদার কথা বলি আমরা? উন্নত দেশগুলোতে মন্ত্রীর গাড়ির আগে শিক্ষকদের গাড়িকে যেতে দেয়, অফিস-আদালতে একমাত্র শিক্ষকরাই বসার জন্য আসন পায়। আমাদের দেশে অফিস-আদালতে শিক্ষকদের বসার জন্য কি কোনোদিন আসন দেয় বরং শিক্ষক পরিচয় দিলে (সে শিক্ষক যত আদর্শবানই হোক না কেন) নাক ছিঁটকায়। তাহলে আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা নিয়ে কোন মুখে বড় বড় কথা বলি? শিক্ষকদের মর্যাদা যদি আমরা সত্যি দিতে চাই তাহলে শুধু মুখে নয় বাস্তবে বেতন গ্রেডসহ সব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মর্যাদা দেয়া হোক।
মাহফিজুর রহমান মামুন : সহকারী শিক্ষক, বোদা, পঞ্চগড়।