প্রতীকের আত্মহত্যা এবং এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মৃত্যু

ড. মো. সহিদুজ্জামান |

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীকের আত্মহননকে কেন্দ্র করে সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন মহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এমন একজন শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যুতে আমরা শোকাহত, ব্যথিত। আমরা তাঁর শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। প্রতীকের পরিবার ও মিডিয়া সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রতীক একজন সম্ভাব্য শিক্ষক প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে বঞ্চিত করার প্রয়াস ও পারিবারিক ঝামেলার হতাশা সম্ভবত তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

শুধু প্রতীক নয়, এ রকম হাজারো প্রতীক ভেতরে ভেতরে মৃত্যুবরণ করছে। সাধারণত দেখা যায়, স্নাতক পর্যায়ে প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন বিভাগে আশ্বাস পেয়ে বা অবস্থা বুঝে মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন। অনেকে আবার আশ্বাস না পেয়েও নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রভাব ম্যানেজ করতে পারলে তিনি সফল হন। বিভাগগুলোতে পছন্দের প্রার্থীকে সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, আত্মীয়তা, আনুগত্যসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করতে দেখা যায়। সম্ভাব্য এসব প্রার্থীর দ্বারা কখনো কখনো বাসার বাজার করানো, মোবাইলে টাকা ভরানো, বিনা পয়সায় অতিরিক্ত কাজ করানোর মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। অনেকে আবার অতি সহজেই এসব ফ্যাক্টর ছাড়াই শিক্ষক হয়ে যান।

একাডেমিকভাবে যোগ্য একজন প্রার্থীকে শিক্ষক হতে হলে তাঁকে বিভিন্ন সিস্টেমের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হয়। দলীয় আনুগত্য, বিভাগীয় অনুকূল পরিবেশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুদৃষ্টি, রাজনৈতিক এবং কখনো বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি। তবে সরকারদলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে অনেক ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হয়। অন্যথায় অপছন্দের প্রার্থীদের যেকোনো সময় যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হতে হয় এমনকি সংবেদনশীল ট্যাগ লাগিয়ে, নাটক সাজিয়ে চরিত্র কলঙ্কিত করতে প্রতিপক্ষ পিছপা হয় না। এককথায় শিক্ষক হতে হলে প্রথমত তাঁর শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা পূরণ করতে হবে, দ্বিতীয়ত তাঁর সরকারদলীয় রাজনৈতিক পরিচয় বা আনুগত্য থাকতে হবে বা অর্জন করতে হবে এবং তৃতীয়ত তাঁকে বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রভাবশালী ছাত্র ও শিক্ষক নেতার সুদৃষ্টি অর্জন করতে হবে বা আস্থাভাজন হতে হবে। এ সবকিছু এক লাইনে থাকলে তাঁর জন্য শিক্ষক হওয়ার টিকিট পাওয়াটা অনেকটাই নিশ্চিত বলা চলে।

অনেক সময় বিভাগীয় শিক্ষকদের দলাদলি বা প্রতিহিংসার শিকার হতে হয় অসহায় শিক্ষার্থীদের। হয়তো বা এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে প্রতীককেও। ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা সচরাচর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁরা নিজেদের একটা গণ্ডির মধ্যে গুটিয়ে রাখেন, রাজনীতিতে তাঁদের আগ্রহ একেবারেই থাকে না। তাঁরা পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিয়ে অর্জিত জ্ঞান, মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে পছন্দের চাকরিটা পেতে চান। কোনো ঝামেলা ও অনিয়মকে তাঁরা ভয় পান। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে হতাশা ও বেদনা তাঁদের তাড়া দেয়। আবার অতি আদর ও ভালোবাসা পাওয়া ছেলে-মেয়েরা অনেক সময় বাস্তবতা ও কষ্ট মেনে নিতে পারেন না। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাই সময়মতো পরিবার ও পরিবেশ থেকে কাউন্সেলিং না পেলে বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্ট অনুযায়ী এমন একটি জায়গা—যেখানে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি আদর্শ, সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদের শিক্ষা অর্জন করা যায়। এটি ধারণ করে সাম্যতা, নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতার পরিবেশ। একসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু জ্ঞানচর্চায় নয়, দেশ ও জাতির চরম সংকটে দল-মত-নির্বিশেষে বড় ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। নৈতিকতার জায়গায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যে অবস্থা বিরাজমান তাতে দেশের সংকটময় সময়গুলোয়ও তাঁদের সঠিক ভূমিকা থেকে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন অবস্থার পেছনে শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই দায়ী নন, সরকার ও রাষ্ট্রের দায় অবশ্যই আছে। রাজনৈতিক সরকারগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় কাজে ব্যবহার করে, তাতেই দিন দিন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার অতি উৎসাহী কিছু রাজনৈতিক শিক্ষকের দলীয় স্বার্থের আড়ালে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টায় শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগকে দলীয় ভোটার নিয়োগের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না।

শিক্ষকতা অন্য কোনো পেশার মতো নয়। তাই বিষয়গুলো অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে। শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা না দিয়ে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক, সামাজিক ও চারিত্রিক শিক্ষা দিয়ে তাদের সুশিক্ষিত করে দিলে তা দেশ ও জাতি গঠনে অনন্য অবদান হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : ফুলব্রাইট ভিজিটিং ফেলো, টাফটস্ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033159255981445