প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত কয়েক দিনের কথাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা কতটুকু উপলব্ধি করেছেন জানি না; তবে তাঁর বক্তব্যের শুধু সমালোচনা না করে আত্মশুদ্ধির জন্য শিক্ষকদের গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, স্বাধীনতা ভালো কিন্তু তা বালকের জন্য নয়। তার মানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের পলিসিমেকারদের এই ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রোববার (৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে আর সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হচ্ছে ভিসিদের বিরুদ্ধে। অনেকে বলেন, যোগ্য লোক নিয়োগ না দিয়ে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। আসলে ঘটনা পুরোপুরি সত্য নয়। অনেক যোগ্য লোক নিয়োগ দেওয়ার পরও তাঁরা ভিসি হিসেবে সফল হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য লোক বলতে সাধারণ ধারণায় কী বোঝা যায়? যার একাডেমি প্রোফাইল ভালো, পিএইচডি করেছেন, পাবলিকেশন অনেক, সাইটেশন অনেক, খুব ভালো শিক্ষক এসবই তো? কিন্তু একজন ভালো একাডেমিশিয়ান যে ভালো ভিসি হবেন, এর কোনো গ্যারান্টি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক যোগ্যতা বেশি জরুরি কারণ ভিসি একটি প্রশাসনিক পদ। ভিসি হতে হলে ভালো প্রশাসক হতে হবে। এ কারণে ভিসি হওয়ার জন্য যখন শিক্ষকদের কাছ থেকে সিভি নেওয়া হয় তখন তাঁদের বিশবিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা যেমন বিভাগীয় প্রধান, ডিন, সিন্ডিকেট মেম্বার, ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা, প্রক্টর, প্রভোস্ট ইত্যাদি দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালনের অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে এখন প্রায় ৫০টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর বেশির ভাগই নতুন, যেখানকার শিক্ষকদের উপরোক্ত প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকায় পুরনো সাত-আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হওয়ার মতো যোগ্য লোক শুধু সাত-আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে যে হিমশিম খেতে হচ্ছে তা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন সবার অবস্থাই লঙ্কার রাবণের মতো হয়। ভিসিরা হয় কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন অথবা তাঁরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ও লোকাল পলিটিশিয়ানদের কন্ট্রোল করতে পারেন না অথবা তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষকদের রোষানলে পড়েন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি। প্রফেসর শরীফ এনামুল কবির একজন অত্যন্ত ঝানু একাডেমিশিয়ান। তিনি পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে পিএইচডি করেছেন। রিসার্চগেটে দেখলাম তাঁর আড়াই শর ওপরে পাবলিকেশন আছে। সেই সঙ্গে তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও অনেক। কিন্তু তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানানোর পর আন্দোলন করে পদত্যাগে বাধ্য করা হলো। এরপর সেখানে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হলো প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে। তিনি জাপানের কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর একাডেমিক প্রোফাইল ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও অনেক ভালো। খুব সম্ভবত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দেওয়ার কারণেই তাঁকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করা হলো। এরপর যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাঁকেও সরানোর জন্য এখন আন্দোলন চলছে। যেসব শিক্ষক এ আন্দোলন করছেন তাঁদের দেখে মনে হয় এই ভিসিকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ দিলেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে পাকপবিত্র স্থান বানিয়ে ফেলবেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না এবং এটা আদৌ কোনো দিন সম্ভব বলে মনে হয় না। আন্দোলনরত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই যে নিজেদের ভিসি হওয়ার পথ পরিষ্কার করতে চান তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের সংগঠনের এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বার হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কীভাবে একজন নতুন ভিসি আসার পরদিন থেকেই তাঁকে বিভিন্নভাবে সরানোর চেষ্টা শুরু হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কয়েকটি গ্রুপ থাকে যাদের অনেকেই ভিসির আনুকূল্য না পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। আর সুযোগ পেলেই কিছু নামসর্বস্বহীন (কিন্তু মিডিয়া ভ্যালু অনেক) বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও সেই আন্দোলনে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলতে থাকে। আর যদি সত্যিই কোনো ভিসি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে তো তাঁর আর রক্ষা নেই। এর বাইরেও একজন ভিসিকে আরও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ফরিদউদ্দিনের কথাই বলি। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে যথেষ্ট জনপ্রিয় তাঁর ছাত্র-শিক্ষকবান্ধব কাজের জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য তিনি ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে সরকার থেকে উন্নয়ন বাজেট নিয়ে এসেছেন। এই বিপুল পরিমাণ টাকার কাজকে দুর্নীতিমুক্তভাবে সম্পন্ন করতে চান বিধায় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তির চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। তারা কিছু হলুদ সাংবাদিকের সহযোগিতায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। অতএব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সামলানোর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতা সেই যোগাযোগ তৈরি করতে পারছেন না তাই অনেকেই ভিসি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। এই চতুর্মুখী চাপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা যে ভিসি হয়ে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছেন এবং তা নিয়ে যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছেন দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত, সমালোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। প্রশ্ন হচ্ছে, ভিসি কারা হন? ভিসি তো নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। তাহলে এর দায়ভার কি শিক্ষকদের ওপর বর্তায় না? বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা ভিসি হিসেবে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবেও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ তো দিতে পারছেনই না; অধিকিন্তু ভিসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মদদ দিয়ে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সরকারের নির্বাহী বিভাগের কোথাও এত আন্দোলন হয় না; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এত আন্দোলন হয় না। অতএব নির্বাহী বিভাগের অন্যান্য শাখার কাজ নিয়ে সরকারের সন্তুষ্টির যেমন কারণ রয়েছে তেমন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অসন্তুষ্টির যথেষ্ট কারণ আছে।

এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলসহ আরও দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে যাওয়ার কতটুকু যৌক্তিক অবস্থান রাখেন তা তাঁদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের জন্য যে কঠিন সময় নেমে আসছে এর জন্য তাঁদের অদূরদর্শী রাজনৈতিক মনোভাবই দায়ী। লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি করে শিক্ষকরা ভিসি তো হতে পারছেন কিন্তু এ পদ তাঁরা যেভাবে কলঙ্কিত করছেন তাতে এ পদ শিক্ষকদের হাতে কদিন থাকে তা সময়ই বলে দেবে। এভাবে বেশি দিন চলতে থাকলে হয়তো এমন সময় আসবে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কিংবা অন্য কোথাও থেকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। সেদিন হবে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের জন্য চূড়ান্ত অপমানের দিন। আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা এ সত্য উপলব্ধি করে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে দেশে শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে এবং শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলায় মনোযোগী হবেন।

লেখক : ড. আবু সিনা, ক্যান্সার গবেষক কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032360553741455