মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ে সরকার নিয়োজিত ‘মেসার্স ব্যুরো ভেরিটাসের পক্ষ থেকে গত ২৮ অক্টোবর এনসিটিবির সচিবের কাছে এক চিঠিতে জানায়, ‘টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস ব্যুরো ভেরিটাসের পরিদর্শন ছাড়াই নিজেদের কেনা কাগজে বই ছাপাচ্ছে। তাদের বারবার সতর্ক করার পরও তারা অননুমোদিত কাগজে বই ছাপাচ্ছে। তাদের ছাপাখানায় অনুমোদনহীন প্রচুর কাগজের রিল রয়েছে।’ এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে সরকার দলীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি সম্পৃক্ত রয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে। শুক্রবার (১ নভেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
এ রকম আরও কয়েকটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজেদের ইচ্ছেমতো কাগজ কিনে বই ছাপার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ অন্যের (ভাড়া করা) ছাপাখানায় বই ছাপতে এনসিটিবির অনুমোদন পেতে কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করছেন, চাপ প্রয়োগ করছেন। তবে বইয়ের মান রক্ষায় অনড় এনসিটিবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শর্ত লঙ্ঘন করে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই মুদ্রণের চেষ্টা করছে অসাধু প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানার মালিক)। নিম্নমানের কাগজে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেয়ায় ১৮টি ছাপাখানার ৬৬১ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করে শর্ত অনুযায়ী পুনরায় কাগজ কিনে বই ছাপতে বাধ্য করেছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)।
প্রাথমিক স্তরেও নিম্নমানের কাগজ সরবরাহ করায় কয়েকটি কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১শ’ মেট্রিক টন কাগজ ছাপার অযোগ্য ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। এছাড়া এনসিটিবির শর্তের তোয়াক্কা না করে বই ছাপার কারণে সাতটি ছাপাখানার প্রায় ৮৫ হাজার কপি বই কেঁটে দিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। কিন্তু অসাধু প্রিন্টার্সদের তৎপরতা চলছেই।
আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপার পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল নাগাদ মোট বইয়ের মধ্যে প্রায় ২৪ কোটি বই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ হয়েছে। আরও ২ কোটি বই সরবরাহের অপেক্ষা রয়েছে। বাকি বইয়ের ছাপার কাজ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে নিস্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপতে অসাধু মুদ্রাকরদের বেপরোয়া তৎপরতা এবং কাগজের মান মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতায় বেকায়দায় পরেছে এনসিটিবি। এবার কাগজের মূল্য প্রতি টনে প্রায় ২০ হাজার টাকা কমলেও এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার চেষ্টা থেকে পিছু হুটছে না। আবার সরকার নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানও কাগজের মান পরীক্ষায় অযথা সময় ক্ষেপণ করছেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ঠেকাতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কমমূল্যে প্রাথমিক স্তরের সব বই ছাপার কাজ নিয়েছে দেশীয় মুদ্রাকররা। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানই কমদামে কেনা নিম্নমানের কাগজে বই ছেপে লাভ পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত।
৭ প্রতিষ্ঠানের বই কেঁটে ফেলা (ধ্বংস) হয়েছে :
এনসিটিবি সূত্র জানায়, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপাসহ নানা অনিয়মের কারণে সাতটি ছাপাখানার প্রায় ৮৫ হাজার কপি বই ধ্বংস করে দিয়েছে এনসিটিবির পরিদর্শকরা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হুমায়রা প্রিন্টার্সের ৩৮০ কপি, লেটার অ্যান্ড কালার প্রিন্টিং প্রেসের চার হাজার ৫০০ কপি, বুকম্যান প্রিন্টিং প্রেসের তিন হাজার ৫০ কপি, ভাই ভাই প্রিন্টিং প্রেসের ২৬ হাজার ৯২০ কপি, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেসের ৫০ হাজার কপি ও শ্রাবণী প্রিন্টার্সের ৫০০ কপি বই ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়া রেজা প্রিন্টার্সের ৩টি পাঠ্যপুস্তকের ফর্মা বিনষ্ট করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা, নিম্নমানের কালি ও গ্লু ব্যবহারসহ নানা রকম অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাতিল (ছাপার অযোগ্য) করা হয়েছে। তাদের পুনরায় দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাগজ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- এবার কাগজের মূল্য টনপ্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা কমেছে। এরপরও কেউ কেউ নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার চেষ্টা করছে।’
উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বইয়ের মান যাচাইয়ের কাজ পেয়েছে ‘কন্টিনেন্টাল ইনস্পেকশন বিডি লি.’ এবং মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের মান যাচাইয়ের কাজ পেয়েছে ‘মেসার্স ব্যুরো ভেরিটাস (বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড)’। এই দুটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বই ছাপার কাগজ অনুমোদন দেয়। তাদের অনুমোদন অর্থাৎ পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়া বই মুদ্রণ শুরু করার কোন সুযোগ নেই।
সরকার আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই ছাপছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এসব বই ছাপতে প্রায় ৯৬ হাজার মেট্রিক টন কাগজ ক্রয় করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই চাপার বেশির ভাগ কাগজই এনসিটিবি ক্রয় করে সরবরাহ করেছে।
প্রাথমিক স্তরের মোট দুই হাজার ১০০ মেট্রিক টন কাগজের মধ্যে এক হাজার ১০০ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল ঘোষণা করেছে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান ও এনসিটিবির কর্মকর্তারা। আর ছাপাখানার মালিকরা নিজেরাই কিনে মাধ্যমিক স্তরের বই ছেপে সরবরাহ করেন।
১ হাজার ৭৬১ টন কাগজ ছাপার অযোগ্য
এনসিটিবি সূত্র জানায়, মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপতে নিম্নমানের কাগজ কেনায় ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাগজ ছাপার অযোগ্য ঘোষণা ও বাতিল করেছে এনসিটিবি। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে শর্ত অনুযায়ী কাগজ কিনে বই ছাপতে বাধ্য করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে অনুপম প্রিন্টার্সের ৮০ টন, ফাহিম প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের ১২, ফাইভ স্টার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের ৫০, নাহার প্রিন্টার্সের ২৬, নিউ সুজন আর্ট প্রেসের ৭২, কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেসের ৩০, কোহিনূর আর্ট প্রেসের ২৫, সৃষ্টি প্রিন্টার্সের ১৫, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের ২৫, কমলা প্রিন্টার্সের ৭৩, ইন্টারনেট ওয়েব প্রিন্টার্সের ৪০, হক প্রিন্টার্সের ৩০, সিটি সানজানা আর আর রূপালীর ৫০, নাজমুন নাহার প্রেসের ১৩, করতোয়া প্রিন্টার্সের ২০ এবং আনমল নিউ অফসেট প্রেসের ১০ মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। এসব কাগজ ৬০ জিএসএমের কম ছিল; ব্রাইটনেসও কম ছিল।
জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) যে প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক স্তরের কাগজের মান যাচাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে, যাদের পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। এই প্রতিষ্ঠানটি এনসিটিবির সঙ্গে কোন যোগাযোগ করছেন না। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কাগজের মান মূল্যায়নের ছাড়পত্র প্রদানে প্রিন্টার্সদের কাছে ‘কমিশন’ চেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতি’র নেতারা। তারা ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেছে। এরপরই কন্টিনেন্টালকে চাপ দেয়া হয় কাগজের মান যাচাইয়ে কিছুটা নমনীয় হতে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র সাহা কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীদের দাবি, কন্টিনেন্টাল তাদের অযথা হয়রানি করছে। আর কন্টিনেন্টাল বলছে, ব্যবসায়ীরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার ছাড়পত্র চান। দুই পক্ষের অভিযোগই আমরা ডিপিইকে জানিয়েছি। তারা আমাদের নিয়ে চারপক্ষের বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল। বিষয়টি মিটমাট হয়েছে।’
এদিকে কন্টিনেন্টাল কর্তৃপক্ষের ওপর আস্থা হারিয়ে এবং তাদের ছাড়পত্র পাইনি এমন ১০৫টি স্যাম্পল সংগ্রহ করে এনসিটিবি বিকল্প পন্থায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বিএসটিআই, বুয়েট থেকে পরীক্ষা করায়। তারা কাগজের কোন সমস্যা পায়নি।
এ ব্যাপারে কন্টিনেন্টাল কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বিএসটিআই, বুয়েট শুধুমাত্র স্যাম্পল পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছে। তারা ছাপাখানায় রাখা পুরো কাগজ দেখেনি। কারণ অনেক ব্যবসায়ী স্যাম্পল দেখান ভালোমানের; আর বই ছাপে নি¤œমানের কাগজে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, ৮০ গ্রামেজের (ভালোমানের) কাগজে বই ছাপার কথা; কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী ৬৫/৭৫ গ্রামেজের কাগজে বই ছাপার চেষ্টা করছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘কন্টিনেন্টাল কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র পেতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বই ছাপার কাজ শুরু করতে কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও তাড়াহুড়ো করে ছাড়পত্র পেতে চান। তাড়াহুড়ো করলে মান রক্ষার বিষয়টি ঝুঁকিতে পড়ে।’
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম কিছুদিন আগে বলেন, ‘কাগজের ব্রাইটনেস ঠিক নেই- এমন অভিযোগে বাতিল করার এক সপ্তাহ পর সেই কাগজের মান ভালো বলে ছাড়পত্র দিয়েছে কন্টিনেন্টাল, এমন প্রমাণ রয়েছে। ৮৮ থেকে ৯০ পার্সেন্টের কম ব্রাইটনেস হলে আর্ট পেপার তৈরিই করা যায় না। অথচ কন্টিনেন্টাল ৮০ পার্সেন্টের কম ব্রাইটনেসের অভিযোগ তুলে আট কার্ডের ছাড়পত্র দিচ্ছে না।’
গত ৩ অক্টোব ডিপিইতে অনুষ্ঠিত এক সভায় কন্টিনেন্টাল ইন্সপেকশন কো. লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মাহবুব উল্যাহ বলেন, ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট কর্তৃক সংগৃহীত যতগুলো নমুনা ল্যাবে টেস্ট করা হয়েছে ততগুলো নমুনা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পুনর্যাচাই করা হলে সেই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য হবে। শুধুমাত্র একটি নমুনা টেস্ট করার কোন অবকাশ নেই।’