মাহমুদুল হাসান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসয়ান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী। কিছুদিন আগে সেমিস্টার ফাইনালের ফলাফল বের হয়। অন্য বন্ধুরা কৃতকার্য হলেও অপ্রত্যাশিতভাবে অকৃতকার্য হয় এ শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য হওয়ার কারণ সম্পর্কে তার বন্ধুরা বলে, ও খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সে অনলাইন গেমিংয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে পড়ে। রাত জেগে ইন্টারনেট ব্রাউজিং, চ্যাটিং, গেমিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়াশোনা ও ক্লাসে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেনি। নিয়মিত ক্লাসেও আসত না। ফলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। মাহমুদের বন্ধু আজিম শেখ বলেন, শুধু মাহমুদ নয়, আমাদের বিভাগের অনেক মেধাবী ছাত্রই অতিরিক্ত অনলাইন আসক্তির কারণে পড়াশোনায় স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।
এ চিত্র শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় বরং সারা দেশের তরুণদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে অনলাইন আসক্তি। এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল রাতজাগা। রাতজাগার ফলে শারীরিক-মানসিক জটিলতা ছাড়াও দৈনন্দিন কাজে পিছিয়ে পড়ছে তরুণরা। আর এ তালিকায় শীর্ষে আছে নগরীর তরুণরা। রাজধানীর অধিকাংশ তরুণ-তরুণী গভীর রাত পর্যন্ত অনলাইন গেমিং, চ্যাটিংয়ে সক্রিয় থাকে। তারা ঘুম থেকে ওঠে দুপুরেরও অনেক পরে।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী তালহা বলেন, আমাদের ৮ জনের একটা সার্কেল আছে। সারা দিনের কাজকর্ম সেরে আমরা রাত ১২টায় অনলাইনে আসি। একসঙ্গে পাবজি গেম খেলি। গেম শেষে চ্যাটিংয়ে মজি। তারপরে ভোর হলে ঘুমুতে যাই। ঘুম ভাঙে দুপুরেরও পরে। তরুণদের এমন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না অভিভাবক ও সচেতনমহল।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সোশ্যাল মিডিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইআর সোশ্যাল ও হুটস্যুট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে। বিশ্বের প্রায় ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ৩৭৭ কোটি; আর তাদের মধ্যে ২৭৮ কোটি ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সক্রিয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সূত্রে জানা যায়, গত বছর পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ৬ লাখ। এর মধ্যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (আইএসপি) মাধ্যমে প্রায় ৫৬ লাখ গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল ডেটার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। আর এসএনএসের মধ্যে ফেসবুকে নিবন্ধিত ব্যক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ। তবে তারা সবাই সক্রিয় নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় অংশই তরুণ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহীত কামাল বলেন, জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ, যারা সমাজের কর্মক্ষম ও চালিকাশক্তি। বিশ্বের প্রতি পাঁচজনে একজন বা ২০ শতাংশ তরুণ মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, মাদকাসক্ত, বুলিং, সাইবার ক্রাইম, গ্যাং কালচার, অবাধ্যতা, দেশীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ, ইন্টারনেট ও ফেসবুক আসক্তি, সম্পর্কজনিত ও মানিয়ে চলার বিষয়ে মানসিক সমস্যা থেকে এ রোগের সৃষ্টি। তিনি আরও বলেন, ভার্চুয়াল জগতে সবকিছু সহজ মনে হলেও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা থাকে না। এতে খুব দ্রুতই তরুণদের মধ্যে হতাশ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। হতাশা মানসিক রোগে পরিণত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ দশমিক ১ শতাংশ আর ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে আক্রান্ত শুধু অতিমাত্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সেলিনা খান বলেন, আমার ছেলের বয়স ১৭ বছর। সে প্রচণ্ড মোবাইল ও ল্যাপটপের প্রতি আগ্রহী। হঠাৎ দেখা গেল সে তার বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই মারপিটে জড়িয়ে পড়ছে। বাসার সবার সঙ্গেও তার আচরণ খুব রুক্ষ। একপর্যায়ে রাগ হলেই জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে আমরা ওকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাই। ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকেরই আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। তিনজন মানুষ পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে কথা না বলে ব্যস্ত থাকে ইন্টারনেটের ঘেরাটোপে। একইরকম বিষয় নিয়ে জরিপ চালিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিটাল ক্ল্যারিটি’। ১ হাজার ৩০০ মানুষের ওপর চালানো এ জরিপে ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রতি মানুষের আসক্তির বিষয়টি জনসমক্ষে উঠে এসেছে।