দ্বিতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা- সব পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। সত্যিকারের পড়ূয়া ছাত্রছাত্রীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি একটি জাতির জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায় একটি মহল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কতিপয় শিক্ষকও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে অপরাধ হলে কঠোর শাস্তি না দিলে সেটি বন্ধ হয়েছে। নাইজেরিয়াকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলেই আমরা জানি। সেখানেও কিন্তু পরীক্ষায় নকল করলে জেলখানায় পাঠানো হয়। আমাদেরও প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
গতানুগতিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রশ্ন ফাঁসের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে গৎবাঁধা প্রশ্ন করলে হবে না। আমি যেটা করছি, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যা পড়ানো হয়, তার ভেতর থেকেই পরীক্ষা নিচ্ছি। এতে এইচএসসিতে পঠিত বিষয়ের বাইরে কোনো প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে না, এই লেভেলে অর্জিত জ্ঞান থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাই করা হচ্ছে। এতে কী হলো? যারা এইচএসসি লেভেল পাস করে এসেছে, তারা চিন্তা করল আমি যা পড়ে এসেছি, সেখান থেকেই তো পরীক্ষা হবে। এতে কোচিং বাণিজ্য কমে গেল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় কোচিং সেন্টারের মাধ্যমেই।
আমি ভর্তি পরীক্ষা থেকে বিভাগ পরিবর্তনকারী ‘ঘ’ ইউনিট বাদ দিয়েছি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, প্রশ্ন ফাঁস সবচেয়ে বেশি হয় ‘ঘ’ ইউনিটে। শিক্ষার্থীদের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স পড়া থাকে না। পাঠ্যবইয়ের বাইরে সাধারণ জ্ঞান থেকে প্রশ্ন হওয়ার কারণে এর প্রস্তুতির জন্য ছাত্রছাত্রীরা কোচিং সেন্টারে যায়। যখনই কোচিং সেন্টারে যায়, তখনই প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা সুযোগ থেকে যায়। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমেই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বেশি। আইন করে হলেও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ কোচিং সেন্টার বন্ধ না হবে, ততক্ষণ এটা চলবেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিট বন্ধ করে দিতে হবে।
বিভাগ পরিবর্তনকারী বা ‘ঘ’ ইউনিটে আলাদা পরীক্ষা না নিয়েও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ রাখা যায়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেটাই করেছি। এতে ছাত্রছাত্রীরা যেমন একটি অতিরিক্ত পরীক্ষার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কেও একটি বাড়তি ইউনিটের পরীক্ষা নিতে হচ্ছে না। আমরা যেটা করেছি, ভর্তির আবেদনের সময় অপশন রেখেছি। যারা বিভাগ পরিবর্তনেরও সুযোগ চায়, তারা আবেদনপত্রে তা উলেল্গখ করে। যেমন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হলে ‘ক’ ইউনিটে আবেদনের সময়ই উল্লেখ করে দেয়, আমি ইউনিট পরিবর্তনেও আগ্রহী। ‘ক’ ইউনিটে সুযোগ না হলে মেধার ভিত্তিতে মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের কোনো বিষয়েও তার ভর্তির সুযোগ থাকে। এর আরও একটি সুবিধা হলো, উচ্চ মাধ্যমিকে অর্জিত জ্ঞান থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে, আলাদা করে অন্য বিষয়ের প্রস্তুতি নিতে হয় না।
ভর্তি পরীক্ষা শেষে আমি প্রশ্নপত্র পুড়িয়ে দিয়েছি। আমার নিজের কাছেও প্রশ্নের কোনো কপি নেই। এতে পরীক্ষার পর কেউ বলতে পারবে না, কী কী প্রশ্ন এসেছিল। এতে প্রশ্ন নিয়ে কোচিং সেন্টার বা অন্য কেউ বাণিজ্য করার সুযোগ পাবে না। পরীক্ষা শুরুর এক মিনিট আগে আমরা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলি। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, অনেক আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুললে অনেকেই দেখে, মোবাইলে ছবি তোলে। এতে প্রশ্ন ফাঁসের আশঙ্কা রয়ে যায়। পরীক্ষার হলে অনেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে আসে। এই ডিভাইসের মাধ্যমে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটছে। এটা ঠেকাতে আমি এবারের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ইলেকট্রনিক জ্যামার’ চালু করেছি। ইলেকট্রনিক জ্যামার পরীক্ষার কেন্দ্র ও আশপাশে মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়। আমাদের দেখানো পথে হেঁটেছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তারাও চালু করেছে এ পদ্ধতি। এভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয় যদি শক্ত হাতে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে অটোমেটিক্যালি প্রশ্ন ফাঁস বা পরীক্ষায় জালিয়াতি বন্ধ হয়ে যাবে।
কঠোর উদ্যোগ নিলে আমার মনে হয় না, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা অসম্ভব। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও দায়িত্ববানদের সতর্ক থাকতে হবে। যারা প্রশ্ন করবেন, সম্ভব হলে তাদের নিজের হাতে প্রশ্ন করতে হবে। অনেকে টাইপ করতে পারেন না। অন্য কাউকে দিয়ে টাইপ করার পর সঙ্গে সঙ্গে সব মুছে ফেলতে হবে, যেন সে মুখস্থ করতে না পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় দেখেছি, প্রশ্ন ছাপা হয় সিকিউরিটি প্রেসে। এমনও হয়েছে, প্রেসের সব কাজ শেষ করে রাত ২টায়ও বাসায় ফিরেছি। তখন তো প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। সিকিউরিটির কাছে কাজ ছেড়ে দিয়ে এলে তো হবে না, আমাকে সেখানে বসে থাকতে হবে। এ কাজের রেসপনসিবিলিটি অনেক। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় আমি বলেছিলাম, এখানে প্রশ্ন ফাঁস হলে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে এর জন্য আমি দায়ী থাকব। এখানে তো প্রশ্ন ফাঁস হয়নি! দায়িত্ববানরা আমার মতো এ রকম যদি বলতেন, হয়তো প্রশ্ন ফাঁস হতো না।
প্রেস থেকে প্রশ্ন পাঠিয়ে দিতে হয় ট্রেজারিতে। এটা নিরাপদ জায়গা। আমি যদি সরকারি ট্রেজারিতে দিই, সব দায়িত্ব ট্রেজারি নেবে। সেখান থেকে ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরীক্ষার হলে যখন যাবে, গার্ড দিয়ে নিরাপদভাবে নিয়ে যেতে হবে। আগেভাবে প্রশ্নপত্র খুললে সেখান থেকে ফাঁসের আশঙ্কা থাকে, তাই আগে প্রশ্নপত্র খোলা যাবে না। পরীক্ষা ১০টায় শুরু হলে ছাত্ররা প্রবেশ করবে ৯টায়। এ সময়টাতে ছাত্ররা রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করবে খাতায়। ইনভিজিলেটররাও এ সময়টাতে স্বাক্ষরসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারবেন। এতে পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রীদের সময় নষ্ট হবে না। ১০টা বাজলেই প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হবে। এতে হল থেকে প্রশ্ন ফাঁসের আশঙ্কা থাকবে না।
গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে সারাদেশ থেকে প্রশ্ন নিয়ে একটা প্রশ্নব্যাংক করা যেতে পারে। ১০ লাখ প্রশ্ন থাকতে পারে সেখানে। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখান থেকে নিয়ে প্রশ্ন করবে। যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্ন নির্বাচন করে অনলাইনে দেওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য সব কেন্দ্রে সার্ভার স্টেশন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, কোনো নেটওয়ার্ক বা কারেন্ট ফেইলর হবে না। পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে প্রশ্ন ছাপা হবে। এতে প্রশ্ন ফাঁসের আশঙ্কা থাকবে না। তবে এটার অসুবিধা একটাই, একটু সময় বেশি লাগবে। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয় কম্পিউটারে বসে, অনলাইনে। প্রত্যেকের সামনে একটি করে মনিটর থাকে। আমাদের দেশে এটা এখনও সম্ভব নয়। ধরে নিই, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লাখ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেবে। এক লাখ কম্পিউটার বা সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত মনিটর আমরা কোথায় পাব? এ কারণে আপাতত প্রশ্নপত্রের হার্ডকপি করা ছাড়া উপায় নেই। গতানুগতিক পদ্ধতিতেও প্রশ্ন ফাঁস রোধ সম্ভব। সৎ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীলদের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে নিয়ে আসতে হবে জবাবদিহির আওতায়। অভিভাবকদেরও এ ক্ষেত্রে করণীয় আছে। এটি যে অনৈতিক ও অন্যায়, ছোটকাল থেকে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের তা বোঝানোর দায় তাদেরও। চাহিদা আছে বলেই জোগান আছে। ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের বোধোদয় বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে।
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার যে পথগুলো আছে, বন্ধ করে দিতে হবে। আমাকে যখন দায়িত্ব দেওয়া হবে, আমি কীভাবে করব, এটার কি সিস্টেম থাকবে, কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যায়, সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে। যদি কোনো কারণে প্রশ্ন ফাঁস হয়, সেটার জন্য আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। দায়বদ্ধতা যতক্ষণ না আসবে এটি রোধ করা যাবে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন করার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এভাবে সব ক্ষেত্রে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই রোধ করা যাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস।
উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: সমকাল