প্রশ্ন ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতির সংকটে দেশ

ড. মো. সহিদুজ্জামান |

ছাত্রজীবনের কথা। একদিন কয়েক বন্ধু মিলে বার্ষিক পরীক্ষার আগে এক স্যারের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার, আপনার বিষয়টি কঠিন লাগছে, একটু যদি সাজেশন দিতেন। অমনি উনি হাঁক ছাড়লেন, কই রে করিম (কর্মচারী) কোথায় গেলি, আলমারির ভেতর প্রশ্ন আছে, এদের দিয়ে দে। দেরি না করে সালাম দিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম স্যারের রুম থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই প্রশ্ন করেন, পরীক্ষা নেন ও খাতা মূল্যায়ন করেন। যুগ যুগ ধরে যে কাজটি করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, সেখানে এমন অবস্থা কেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত দেখা যায়, এক বা একাধিক প্রশ্নপত্র প্রণেতার কাছ থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে তা দু-তিনজন মডারেটর এক বৈঠকে প্রশ্ন নির্বাচন করেন, পরবর্তী সময় নির্বাচিত প্রশ্নগুলো কম্পোজ করে প্রুফ রিডিংয়ের পর প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং করা হয়। সিলগালা প্যাকেটটি নিরাপদে সংরক্ষণ করে পরীক্ষার দিন কেন্দ্রপ্রধানের কাছে সরবরাহ করা এবং পরীক্ষা শুরুর নির্দিষ্ট সময় আগে তা হল বা কক্ষপ্রধানকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। হলপ্রধানকে হলের সব পরিদর্শকের সামনে প্যাকেটটি খুলতে হয়। সব কাজ করা হয় অতি সাবধনতা ও নৈতিকতার সঙ্গে এবং একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতিতে সাক্ষী হিসেবে। বৃহত্তর পরিসরে (বোর্ড পরীক্ষায়) এই কাজগুলো সাবধানতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে করতে খুব বেশি সমস্যা হবে না বলে আমার বিশ্বাস। তবে অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে সরবরাহ পর্যন্ত হাতবদল যত কম হবে ততই ঝুঁকি কমবে।

সরকার আগে থেকেই বিভিন্ন সতর্কতা ও প্রস্তুতির কথা বললেও প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তারপর প্রতিদিনই নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের? আবার নতুন করে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত হলে মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। মনোবল হারিয়ে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে লেখাপড়ায়। ধ্বংস হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ অবস্থায় দেশ ও জাতি কঠিন এক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এ সংকট শিক্ষার সংকট, এ সংকট জাতির সংকট। কোনোভাবেই থামছে না এই সংকট। তবে এটি বেশিদিন চলতে থাকলে এ জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

যে শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়ে তার জীবনটি শুরু করল, সে সামনে নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে কতটুকু তৈরি করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী এসএসসি হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের সোপান। এসএসসির প্রাপ্ত নম্বরের ওপর নির্ভর করে একজন শিক্ষার্থীর সামনে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি। শিক্ষার্থীদের জীবন এভাবে শুরুতেই বিনষ্ট করার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ক্ষমার অযোগ্য।

প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বিভিন্ন সময় লেখালেখি হয়েছে, এখনো হচ্ছে, অনেক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা গেছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেসব পদক্ষেপ প্রতিনিয়ত সংযোজন করছে তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ জটিল কোনো বিষয় নয়, শুধু প্রয়োজন কর্তৃপক্ষ বা সরকারের প্রবল ইচ্ছাশক্তি।

এটি সত্য যে অভ্যন্তরীণ কোনো সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস সম্ভব নয়। প্রশ্ন তৈরি থেকে শুরু করে পরীক্ষার হলে সরবরাহ পর্যন্ত যেকোনো ধাপে প্রশ্ন ফাঁস বা কারচুপি হতে পারে। তাই প্রতিটি ধাপেই সতর্ক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে প্রান্তিক বা পরীক্ষার কেন্দ্র পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের বা জালিয়াতির আশঙ্কা বা ঝুঁকি সাধারণত কম থাকলেও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আশঙ্কা অনেক বেশি। কারণ এখানে প্রশ্নপত্র মডারেশন, কম্পোজ, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো হয়ে থাকে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যাই নয়, পদ্ধতিগত, ব্যবস্থাপনা ও নৈতিকতাজনিত সমস্যাও বটে। প্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যবহার করেও প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো একটি বিষয়ের প্রশ্ন তৈরিতে একাধিক শিক্ষক (কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষক) থেকে নমুনা প্রশ্নপত্র (২৫ বা ৩০টি এমসিকিউসংবলিত) সংগ্রহ করে যদি তা সফটওয়্যার দ্বারা অক্রম নির্বাচনের (রেনডম সিলেকশন) মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশ্নপত্র (একাধিক সেটও তৈরি সম্ভব) স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করা হয়, তাহলে প্রশ্নপত্র তৈরিতে নমুনা প্রশ্ন সরবরাহকারী, মডারেটর ও কম্পোজারদের মাধ্যমে জালিয়াতির আশঙ্কা কমে যাবে। এভাবে এক ব্যক্তিনির্ভর প্রশ্নপত্র তৈরীকরণ সম্ভব হবে। এরপর শক্তিশালী সার্ভারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করে প্রশ্নপত্র স্থানীয়ভাবে মুদ্রণ ও বিতরণের কাজগুলো করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিটি কেন্দ্রের নির্ধারিত ব্যক্তিকে প্রতিটি বিষয়ের জন্য ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড ও ইউজার নাম সরবরাহ করে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে ততক্ষণাৎ প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করা যেতে পারে। প্রিন্টকৃত প্রশ্নপত্রগুলো সরাসরি প্যাকেটে ভরিয়ে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি প্যাকেটের মুখে সেন্সর বা ডিজিটাল ট্যাগ লাগানো যেতে পারে, যাতে প্যাকেটটি খুললে সিগনাল পাওয়া যায়। এসব কাজ করার সময় দায়িত্বরত ব্যক্তিদের বাইরের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। এরপর সার্ভার ডাউন করে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিটি ধাপে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে রুমের বাইরের ও ভেতরের সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।

পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করা যেতে পারে। এমসিকিউ প্রশ্ন না রেখে এর পরিবর্তে ছোট ছোট প্রশ্ন, শূন্যস্থান পূরণ রেখে পরীক্ষার সময় বাড়ানো যেতে পারে। যদিও এ ক্ষেত্রে উত্তরপত্র মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ হবে। বিভাগওয়ারি ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্র ও একাধিক সেট ব্যবহারে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি কমে আসবে।

মোবাইল ফোন বা রেডিও ট্রান্সমিটারের সিগনাল প্রবাহে বাধা দিতে অনুমোদিত জ্যামিং ডিভাইস অথবা রেডিও ওয়েভ ব্লাইন্ড স্পট সৃষ্টিকারী ডিভাইস ব্যবহার করা যেতে পারে। নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরীক্ষার স্বার্থে পরীক্ষার্থীকে প্রয়োজনে পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে হাজির করে মেটাল ডিটেক্টর বা নিরাপত্তা যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীকে যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মেটাল বহনে বাধা দিতে হবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধানসহ আইন রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। সময়ের আবর্তে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির ধরন পরিবর্তিত হওয়ায় এবং প্রযুক্তিগত ব্যবহার ও জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি কমাতে এ আইন সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তি ও ডিজিটাল আইনের সমন্বয় করা যেতে পারে। এমনকি এসব কর্মকাণ্ডে যেসব অভিভাবক টাকা ব্যয় করছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জালিয়াতির ধরন এবং অপরাধজনিত শাস্তিগুলো উল্লেখ করা প্রয়োজন। এতে একজন পরীক্ষার্থীর অপরাধপ্রবণতা বেশির ভাগই কমে যাবে। এ ছাড়া প্রবেশপত্রের সঙ্গে প্রতিটি অভিভাবকের কাছে জালিয়াতির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে চিঠি দেওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতিতে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের দক্ষ সামরিক বা বেসামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের সহায়তা নিয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিটি বিভাগে ভিন্ন প্রশ্নপত্র ও একাধিক সেট ব্যবহার করে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতিতে সুবিধা করার সুযোগ কমে আসবে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে দ্রুত বিচার আইনে বিচারকার্য সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028481483459473