প্রশ্ন ফাঁস কি অপ্রতিরোধ্য!

গোলাম কবির |

সম্প্রতি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে পত্রপত্রিকায় আসছে। পরিতাপের বিষয়, প্রকৃত হোতাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বা হচ্ছে না। বিষয়টি এমনই মহামারি আকার ধারণ করেছে যে অবোধ শিশুর প্রথম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নও এই সর্বনাশা ধ্বংসপ্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ছে না।

অনুমানভিত্তিক সন্দেহভাজন হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী অথবা সমীক্ষক অর্থাৎ অসাধু শিক্ষক এসবের পেছনে রয়েছেন। কারো ধারণা, প্রশ্নপত্র মুদ্রণের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারাই জাতিবিধ্বংসী এ কাজে জড়িত। আমরা আমজনতা অত সব বুঝি না। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা অচিরেই আফ্রিকার একসময়ের জ্ঞানবর্জিত ‘হটেনটট’ জাতিতে পরিণত হব, সে সত্য কিঞ্চিৎ বুঝতে পারি। দুঃখের বিষয়, এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ যাদের দেখভালের কথা, তারা বোধ করি নির্বিকার অথবা কিছু রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যাচ্ছে। ঘাতকের বিচার ফাঁসি কার্যকর করা। প্রশ্ন ফাঁস করে যে বা যারা গোটা জাতিকে হত্যা করছে, তাদের এর চেয়ে কঠিন শাস্তি বাঞ্ছনীয় নয় কি?

একটু পেছন ফিরে দেখি। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রের আভাস দেওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণের আগে একসময়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে বুঝিয়ে দিতেন প্রশ্নের ধরন কেমন হবে। এসব বিষয় প্রশ্ন ফাঁসের পর্যায়ে পড়ত না। কারণ কিভাবে, কেমন করে ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন হয়, তা বুঝিয়ে দেওয়া শিক্ষকের দায়িত্ব। প্রশ্ন ফাঁস করা নয়। শিক্ষকরা এই পবিত্র আমানত প্রাণপণে রক্ষা করতেন। কোনো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে, প্রিয় পাত্রদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন বলে দিয়েছেন কিছু শিক্ষক নামের ব্যক্তি। এগুলো নিয়ে কথা উঠলেও মানুষ তেমন মাথা ঘামায়নি। কারণ ওপরের শ্রেণির ছাত্ররা শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করে তারপর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেত। প্রশ্নপত্রের আভাস পেয়ে হয়তো অনেকে ভালো ফল করত, তবে আখেরে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাইরের সম্মানজনক পদে জায়গা পেত না। এ নিয়ে হাসাহাসি কম হয়নি। এখনো হয়, তবে তা অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।

একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অবিভক্ত বাংলায় সারা দেশে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পরিচালনা করত। দেশ ভাগের পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড একই পরীক্ষা সুচারুরূপে গ্রহণ করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব শোনা যায়নি। এখন প্রায় প্রতিটি বিভাগে শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত। ভালো খবর হলো, এতে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে, তার সঙ্গে বেশ কিছু পোঁ ধরা মানুষের উচ্চাসনে বসার সুযোগ হলেও শিক্ষা ও পরীক্ষাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের সংবেদন লুণ্ঠিত হয়েছে। দলীয় মাপকাঠিতে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োজিত হচ্ছেন। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষক পরীক্ষাসংক্রান্ত গোপনীয় কাজে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। কে না জানে জ্ঞানে যারা দুর্বল চারিত্রিক, দৃঢ়তায় তারা কদাচিৎ সবল হয়। তা ছাড়া প্রশ্ন মুদ্রণের সময় নানা পথঘাট আছে। সব মিলিয়ে এখন চারপাশে শুধু অন্ধকার। সত্য কথা বলতে কী, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে তলানিতে। প্রশ্ন ফাঁস এখন নিত্যদিনের ঘটনা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পরীক্ষা গ্রহণের আয়োজন এখন যেন হাস্যকর এবং প্রহসন।

আমাদের দুর্ভাগা দেশে শিক্ষা আর পরীক্ষা নিয়ে যত ভাঙাগড়া হয়েছে, আর কোথাও হয়েছে কি না বলা কঠিন। নিকট-অতীতে পরীক্ষায় নকল রোধ করার জন্য বড় উত্তর-প্রশ্ন কমিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্নে নামিয়ে আনা হলো, এতেও উর্বর মস্তিষ্কের মন্ত্রণাদাতাদের মন ভরল না। প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করা হলো। যা একধরনের প্রশ্ন ফাঁসের শামিল। এতে কিছু কর্মকর্তা ও গাইড প্রকাশকের পকেট ভারী হলো; কিন্তু পরীক্ষার বারোটা বাজতে শুরু করল। প্রযুক্তির অভিশাপে ও শিক্ষক-মুদ্রকদের দেশপ্রেমহীন কর্মতৎপরতায় প্রশ্ন ফাঁস একেবারে ডালভাত হয়ে গেল। যার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকে।

ব্যক্তিস্বার্থের অর্থাৎ পকেট ভারী করার জন্য এবং নকল রোধের উদ্দেশ্যে খোল-নলচে বদল করে কোনো লাভ হয়নি। অথচ আবার ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো সৃজনশীলতা আমদানি করা হলো না বুঝেই। রবীন্দ্রনাথের কথায় সৃজনশীলতা তার পক্ষে সম্ভব ‘যার বক্ষে বেদনা অপার’। তাই যিনি শেখাবেন এবং শিখবেন তাঁর অন্তর্লোকে সৃজনশীলতার স্ফুলিঙ্গ না জ্বললে জ্ঞানের রশ্মি জ্বলবে কিভাবে! আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘ উত্তর-প্রশ্নে পরীক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের সঙ্গে তার মুনশিয়ানাও যাচাই হয়ে যায়। নকলও অনেকাংশে রোধ হয়। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে প্রশ্ন ফাঁস হলেও দীর্ঘ প্রশ্নের উত্তর তৈরি করা প্রযুক্তিতে সহজ নয়।

এত সব যুক্তি আমরা যেভাবেই পরিবেশন করি না কেন, তাতে কাজের কাজ তেমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর জন্য গোড়ায় হাত দিতে হবে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী যদি মেধাবী না হন এবং নোট বা গাইডনির্ভর প্রশ্ন করেন, তবে কম্বলের লোম বাছার মতো পরিণতি হবে। প্রশ্ন ফাঁস হতেই থাকবে। কারণ তৈরি করা উত্তর তো নোটে-গাইডে আছেই। তা ছাড়া পরীক্ষাকক্ষে যাঁরা দায়িত্বে থাকবেন, তাঁরা দুর্বাসার মতো হবেন নির্মোহ-নির্মম। আর যাঁরা আইন-শৃঙ্খলা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন, তাঁদের সামনে-পেছনে দুদিকেই খোলা চোখ থাকতে হবে।

এখন আমাদের চারপাশে অনেক মেধাহীন, দায়িত্বহীন শিক্ষক নামের মানুষের আনাগোনা। তাঁরা অনেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে নকলের পথ ধরে শিক্ষকতায় এসে সরকারি বসন পরেছেন। তাঁদের দিয়ে নকল এবং প্রশ্ন ফাঁস রোধ অনেকটা সোনার পাথর বাটির মতো। কথাগুলো শুনতে কঠিন মনে হতে পারে। তবে ভুক্তভোগী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

শিক্ষা আর পরীক্ষা নিয়ে নমনীয়তা কোনোক্রমেই একটি উদীয়মান জাতির জন্য কাম্য নয়। আমাদের সাবেকি পরীক্ষাব্যবস্থা যা ছিল, তা ফিরিয়ে এনে যদি যথাযথ পরিচর্যা করা যায়, তবে আবার সুদিন ফিরে আসবে—আশা করা অন্যায় নয়।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002838134765625