প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতি

ড. শফিক আশরাফ |

প্রবাদে আছে, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। শিক্ষালয় যেহেতু জাতি গঠনের সূতিকাগার, এখানে পাঠ নিয়ে রাজনীতিক, আমলা, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকসহ জাতির পরিচালক ও পরিকল্পনাকারীরা বের হন। সেহেতু শিক্ষালয়ও জাতির মাথা। প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি জাতির মাথায় পচন শুরুর লক্ষণ! আর এর ফলে যে পতন শুরু হলো সেটা রোধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে তা মহা পতনে রূপ নেবে। দেশে বর্তমানে ব্রিটিশ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান। ডায়াসে দাঁড়িয়ে লেকচার সিস্টেম, পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি—এ সবই ব্রিটিশদের দান। তবে যাঁরা এই সিস্টেম এখানে চালু করে গেছেন তাঁদের ওখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতির মতো গুরুতর কোনো অপরাধ নেই। আর আমাদের এখানে এটা প্রায় সাম্প্রতিক সমস্যা। শত বছরের বেশি সময় ধরে এই সিস্টেমে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। এর কারণ কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নাকি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়?

পরীক্ষা বা প্রশ্ন হলো পঠিত জ্ঞানকে মূল্যায়ন করার একটা সনাতন পদ্ধতি। প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মানেই জ্ঞান অনুসন্ধান করা। প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের আমলে প্রশ্ন এবং তার উত্তর অনুসন্ধান একটা পরিপূর্ণ রূপ পায়। প্রাচীন গ্রিসের লোকজন দেবী ডেলফির ভক্ত ছিল। তারা ডেলফির মন্দিরে যেত দৈব বাণী চয়ন করার জন্য। সেখানে তারা একদিন জিজ্ঞেস করল—‘আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে?’ মন্দির থেকে দৈব বাণী ঘোষিত হলো—‘সক্রেটিস হলো তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।’ সক্রেটিসের কানে যখন এ কথা গেল, সক্রেটিস খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন এ কথা কেন বলা হলো! আমার তো তেমন কোনো জ্ঞান নেই, আমি জ্ঞানী না। আমাকে জ্ঞানী বলা হলো কেন? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রমাণ করে দেখাবেন তিনি জ্ঞানী না। দৈব বাণী মিথ্যা। এলাকার অনেকেই যাঁকে জ্ঞানী বলে জানেন, সকালবেলা তিনি তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি যে বিষয়ে জ্ঞানী বলে সবাই জানে সে বিষয়ে তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করলেন। কয়েকটি প্রশ্নের পরেই ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন এবং রেগে গিয়ে সক্রেটিসকে বের করে দিলেন।

সক্রেটিস নিশ্চিত হলেন সবাই যাঁকে জ্ঞানী বলে জানে তিনি আসলে জ্ঞানী না! কিন্তু সমস্যা হলো ভদ্রলোক যে জ্ঞানী না তিনি সেটা জানেন না! এভাবে তিনি আরো কয়েকজনের কাছে গেলেন এবং একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সবাই যাঁদের জ্ঞানী বলে জানে তাঁরা আসলে জ্ঞানী না! কিন্তু তাঁরা কেউই জানেন না যে তাঁরা জ্ঞানী না! আর সক্রেটিসের যে জ্ঞান নেই এটা নিজে জানেন। অতএব তিনি তাঁদের থেকে জ্ঞানী। এখানে জ্ঞান নিশ্চিত করার জন্য সক্রেটিস যে প্রশ্ন করেছিলেন সেটা সক্রেটিসের ‘চেইন কোয়েশ্চেনস’ হিসেবে খ্যাতি পায়। এখানে জ্ঞান যাচাইয়ের পদ্ধতি হলো প্রশ্ন।

আমাদের পাঠ্য বইয়ে বিভিন্ন জ্ঞানের কথা বলা থাকে। শিক্ষার্থীদের সেটা পড়তে হয়, মনে রাখতে হয় এবং পরীক্ষার খাতায় তা উপস্থাপন করতে হয়। কেউ যদি না পড়েই, না জেনেই পরীক্ষার খাতায় জ্ঞানের কথা লিখে এসে ভালো নম্বর পায়, পাশাপাশি সত্যি সত্যি জ্ঞানী শিক্ষার্থী না জানা শিক্ষার্থীর চেয়ে কম নম্বর পায় এটা বড় ধরনের ইনজাস্টিফিকেশন! আর আমাদের দেশে এসএসসি, এইচএসসি পর্যায়ের নম্বর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে যোগ করা হয় এবং প্রভাব ফেলে। ভয়ংকর কথা হলো—পিইসি, জেএসসির মতো শিশুদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে! আমাদের শিশুরা দেখে বেড়ে উঠছে, পড়তে হয় না! না পড়েও আগের রাতে মা-বাবা বা অন্য কেউ প্রশ্ন এনে দেয় আর সেটা দেখে পরীক্ষার খাতায় উত্তর ঝেড়ে এলেই হলো! আমরা নিজের অজান্তেই জালিয়াত প্রজন্ম তৈরিতে ভূমিকা রাখছি! শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে আমাদের উচিত ছিল—যে শিক্ষক বা যে জালিয়াতরা বাচ্চাদের প্রশ্ন এনে দেয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা, এটা আপনি কোথায় পেলেন? এটা কেন করলেন? তাদের ধরিয়ে দেওয়া, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তা না করে অর্থের বিনিময়ে সেই প্রশ্ন কিনে আমরা আমাদের বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছি! আমরা আমাদের দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে হৈহৈ করছি, পুরো দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। নিজের অজান্তেই জাতির পতন ও পচনের অংশীদার হচ্ছি। আর এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে মেডিক্যাল-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতচক্রের কয়েকজন ধরা পড়েছে। সেখানে শিক্ষকসহ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে জালিয়াত ধরার চেয়ে চেপে রাখার কৌশলে এগোচ্ছে। এখানে যেটা মহা আশঙ্কা নিয়ে আসছে সেটা হলো, শিক্ষকের নাম উঠে আসছে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতিতে। শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, শিক্ষকরা এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। পত্রপত্রিকায়ও কখনো শিক্ষকদের নাম আসছে। তাহলে কি সর্বনাশের সব চক্র পূর্ণ হলো! জালিয়াতির মাধ্যমে পাস করতে করতে তাঁরা এখন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন! নাকি চূড়ান্ত ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ই এর কারণ।

শিক্ষকতা অন্যান্য চাকরির মতো গতানুগতিক কোনো চাকরি নয়, এটা একটা পেশা। জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের পেশা। শিক্ষার্থীরা প্রায় সারা জীবন ধরে তাদের শিক্ষকদের মনে রাখে। শিক্ষকদের সম্মানের ধস এ দেশে পাকিস্তান আমল থেকেই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পদলেহন করে উপাচার্য পদ বাগিয়ে নিয়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব অপ্রতুল নয়। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস, ভর্তি জালিয়াতিতে শিক্ষক! এটা পুরো শিক্ষকসমাজের মর্যাদায় বড় ধরনের আঘাতই শুধু নয়, এটা জাতির পতন ও পচনের সার্বিক লক্ষণ প্রকাশ করছে। সুতরাং আপনার আমার সন্তানকে শিক্ষার জন্য নিয়োজিত শিক্ষকদের দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আর আমি আপনি একটু সচেতন হলেই খুব সহজেই পারি এই প্রশ্ন ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতি রুখতে। কারণ যারা এটা করে তারা আমাদের পরিচিত, তাদের নিয়েই আমরা বসবাস করি। আমাদের পচন ও পতন ঠেকাতে সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে আমাদেরই প্রতিরোধ করতে হবে এই শিক্ষা-নৈরাজ্য আর ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষকদের মর্যাদা।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061438083648682