সৃষ্টির উষালগ্ন হতে শিক্ষার আলোই মানুষকে সামনের পথ দেখিয়েছে, পথ চলতে শিখিয়েছে। তাই’ত জীবনের মান উন্নয়নে ও সভ্যতার বিকাশে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
আমরা জানি, মানুষের জন্যে আল্লাহর সর্ব প্রথম বাণী ছিল “ইকরা বিছমি রাব্বিকাল্লাজী খালাক” অর্থাৎ- হে নবী পড় তোমার সৃষ্টিকর্তার নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।..............। তার সর্ম্পকে জ্ঞান অর্জন কর। মানব সৃষ্টির পর পরই আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন প্রতিটি নর-নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ অথাৎ জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, আজও এ বানী যথার্থ বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিটি মানুষের শিক্ষা লাভের অধিকার আছে একথা জাতিসংঘের মানবধিকার ঘোষণায় ২৬ (১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে নিরক্ষর রয়েছে। আবার আমাদেও সংবিধানের ১৭ ধারায় শিক্ষা সার্বজনীন অধিকার একথা স্বীকৃত থাকলেও আমাদের দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠি আজও শিক্ষার আলো পায়নি।
৮ সেপ্টেম্বর আর্ন্তজাতিক সাক্ষরতা দিবস। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জন্যে এই দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের মানুষকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত কওে কল্যাণকামী ও উন্নয়নশীল সমাজ গঠনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো এ দিবস পালনের ঘোষনা দেয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের পর নিরক্ষর মানুষের মনে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইউনেস্কো প্রথম থেকেই ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ১৯৪৬ সাল থেকে মৌলিক শিক্ষা পরিপোষণ শুরু করে। এরপর ১৯৫২ সালে ইউনেস্কো নিরক্ষতা দুরীকরণের লক্ষ্যে জরীপ কাজ শুরু করে। তারপর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের উদ্যোগ গৃহীত হয় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে।
ঐ বছরের ডিসেম্বও মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক অধিবেশনে বিশ্বকে নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যেমানের ”রেজা শাহ পাহলবী সাক্ষরতা পুরস্কার” ঘোষণা করা হয়। তানজানিয়ার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নিরক্ষরতা দুরীকরণে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে প্রথমবারের মত এ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬২ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নিরক্ষরতা দুরীকরণ কংগ্রেসের অধিবেশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো-এর উদ্যোগে ইরানের রাজধানী তেহরানে সাক্ষরতে কার্যক্রম সংক্রান্ত ১২ দিন ব্যাপি বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত সম্মেলনে প্রতিবছর ৮ ই সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাক্ষরতা কার্যক্রমে বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এদিকে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে সারা বিশ্ব। আলোচনা সভা, সেমিনার, পদযাত্রা, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণমুলক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে শিক্ষার প্রসার হয়েছে সত্য তবু নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে আমরা পরিপূর্ণ মুক্ত হতে পারিনি, বিশেষ করে তৃতীয় বিশে^র উন্নয়নশীল দেশগুলির চিত্র এখনও হতাশাব্যঞ্জক। এর প্রধানতম কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কেননা যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে তুলনায় শিক্ষা সম্প্রসারণ হচ্ছে না। তাছাড়া দারিদ্র, কর্মসংস্থানের অভাব অর্থাৎ বেকারত্ব নিরক্ষরতা দুরীকরণের অন্তরায়। আবার শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমেই এই সকল অন্তরায় দুর করা সম্ভব।
শিক্ষা ছাড়া আত্নিক মুক্তি, আর্থিক মুক্তি কিংবা অধিকারের মুক্তি কোনটাই সম্ভব নয়। আমাদের আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে যে, অবক্ষয় ও অসহনীয় বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে শিক্ষার অভাব এবং কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের প্রভাব। শিক্ষা হল আলো। আজও আমাদের দেশে প্রায় শতকরা ত্রিশ ভাগ মানু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাই’ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে দেশের প্রতিটি মানুষকে নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে শিক্ষার আলো দান করা লক্ষ্যে বাংলাদেশে কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। একথা খুবই সত্য যে, সীমিত সম্পদের দ্বারা আমাদের দেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে সল্প সময়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আওতায় আনা সম্ভব নয়। সেকারণে উপানুষ্ঠানিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সমম্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা নামে একটা স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে থেকে ৬৮ টি থানায় এবং ১৯৯৩ সাল হতে সারাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৬২% তে উন্নীত করার চুক্তিপত্রে বাংলাদেশ সাক্ষর করে। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ তিনটি বিষয়ে অঙ্গীকার করেছে। তার দুইটিতে সফল হয়েছে তার প্রথমটি হল সাক্ষরতার হা ৬২% তে পৌছান এবং গ্রস এনরোলমেন্টের হার ৯৫ শতাংশ অর্জন। তবে তৃতীয় যে অঙ্গীকার ছিল ড্রপ আউট ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা, এখনও সম্ভব হয়নি। এই ড্রপআউটের প্রধান কারণ হল দারিদ্রতা। তবে শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর ফলে ড্রপ আউটের হার কমে আসছে। এখানে আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনের কোন অঙ্গীকার না থাকলেও বাংলাদেশ এতে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের দেশে ছেলে-মেয়ের অনুপাত ৫১ঃ৪৯।
এক তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশ ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাত্র ৫ বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে শতকরা ১৪ ভাগের বেশী, যা সত্যি উল্লেখ করার মত। তবে আমাদের এখনও অনেক পথচলা বাকি। আমরা যদি আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, তারা মোটামুটি শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য-নির্ভর বিশ্বপরিমন্ডেলে জাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকতে হলে অবশ্যই শিক্ষার প্রসার ও বিস্তার ঘটাতে হবে। বিশেষ করে যুগোপযোগী প্রযুক্তিঘনিষ্ঠ শিক্ষার প্রসার একান্ত প্রয়োজন। আশার কথা, সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সাথে সকলের সহযোগীতার বিষয়টি আমাদেও ভুলে গেলে চলবেনা।
ইউনেস্কো সাক্ষরতা বা শিক্ষিতের নূন্যতম যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে কোন ব্যাক্তি নিজ ভাষায় পত্র লিখে মনের ভাব প্রকাশ করার সামর্থকে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ সরকার এ মানদন্ডকে সামনে রেখেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্যে উপবৃত্তি, সর্বপরি সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচীকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সমন্বিত ও সর্বমূখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। একথা খুবই সত্য যে, কেবল মাত্র সরকারের পক্ষে নিরক্ষরতা দুর করা সম্ভব নয়। তাই সমবেত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ বারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সাক্ষরতা অর্জন কর দক্ষ হয়ে জীবন গড়’- এ অঙ্গীকার নিয়ে সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সফল হোক এই প্রত্যাশাই করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ