২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় সৈয়দ মোশারেফ-রশিদা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) সেতুর পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি নদীভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে গত বছর। ভাঙন থেকে রক্ষায় বিদ্যালয় ভবনের পাশে কাঁকর ও বালির বস্তা ফেলা হয়। তবে শেষরক্ষা হয়নি। গত আগস্টে এক রাতের ব্যবধানেই নদীগর্ভে বিলীন হয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতি বছর বিভিন্ন দুর্যোগে বিলীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ১৪ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তথ্য নিয়ে ব্যানবেইস প্রতি বছর ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদন তৈরি করে। ব্যানবেইসের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনের খসড়ায় বিগত বছরে দেশের দুর্যোগকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে মোট ১৪ হাজার ২৬৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যানবেইসের পরিচালক ফসি উল্ল্যা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়ার জন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দুর্যোগকবলিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্যোগপরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার খুব কম থাকে। দুর্যোগপরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি খুবই সাধারণ। এর অন্যতম কারণ—বাসস্থান স্থানান্তর, শিক্ষা উপকরণ হারিয়ে ফেলা, রাস্তাঘাটের সমস্যা, পারিবারিক অসচ্ছলতা, বকেয়া ফি ও পারিবারিক কাজে সহযোগিতা।
প্রতি বছর বন্যা, জলাবদ্ধতা ও অন্যান্য দুর্যোগে ভবন-অবকাঠামোর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কিছু প্রতিষ্ঠান মেরামত হলেও বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই দুর্যোগের ধকল কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। ২০১৭ সালে বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার মতো বিভিন্ন দুর্যোগের কবলে পড়া তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বলে গত বছর ব্যানবেইসের এক গবেষণায় উঠে আসে।
এর আগে ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ও ব্যানবেইসের পৃথক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণেই দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সমস্যায় পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৬ সালে সাতক্ষীরা, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজার ও কুড়িগ্রামসহ দেশের ১২টি জেলায় ১ হাজার ৮০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরিপ চালায় সংস্থা দুটি। এর মধ্যে প্রাথমিক ৮৪৩, মাধ্যমিক ৫৫০, মাদ্রাসা ৩২৯ ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৭৮টি। জরিপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ৪৬ দশমিক ৭২ শতাংশ সরকারি অর্থায়নে আর ৫৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত।
জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্যোগ মোকাবেলায় তাত্ক্ষণিক অর্থের প্রয়োজন থাকলেও এ ধরনের কোনো তহবিল নেই উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেয়নি ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। দুর্যোগের পর প্রাথমিক সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেই ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবলের দুর্যোগ মোকাবেলায় কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
জরিপভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো সংকটের চিত্র তুলে ধরে ইউনেস্কো ও ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেক শ্রেণীকক্ষই ব্যবহারের অনুপযোগী। নিরাপদ পানির উৎস না থাকা, খেলার মাঠের অভাব, স্কুলের বেশি দূরত্ব, শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতার হার বেশি। এজন্য উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীকে শিক্ষাব্যবস্থায় আকৃষ্ট করতে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। অথচ এর বিপরীত চিত্রই উঠে এসেছে গবেষণায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুতি নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীকেও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এজন্য উপকূলীয় অঞ্চলের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষভাবে অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
সূত্র: ব্যানবেইস