প্রাথমিক শিক্ষকের মান নিয়ে বিতর্ক

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমার প্রাইমারি স্কুল জীবনের শিক্ষকের কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। একজন মাত্র শিক্ষকের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছি। তিনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। হাত ধরে ধরে বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা লেখা শিখিয়েছেন। পিতার স্নেহ দিয়ে আদর ও শাসন, দুটোই করেছেন। তিনি আমার দ্বিতীয় জন্মদাতা ছিলেন। কান ধরে কত যে উঠবস করিয়েছেন। টিনের শ্লেটের কাঠের ফ্রেমে কত যে মারধর করেছেন-সে সবের কোনো হিসেব নেই। এ নিয়ে মা-বাবার কাছে অভিযোগ দিয়ে কোনোদিন ফল পাইনি। উল্টো বকুনি খেয়েছি। নল খাগড়া ও ছনের চালা ঘরের স্কুলে পড়েছি। ঝড়-বাদলে বছরে এক দু’বার স্কুল ঘর মাটিতে পড়ে যেত। তাতে লেখাপড়ার কোনো সমস্যা হয়নি। স্কুলের পাশেই শিক্ষকের বাড়ি। নিজে কাঁধে করে ডেস্ক-বেঞ্চ বাড়িতে নিয়ে যেতেন। যতদিন স্কুল ঘর উঠতো না, ততদিন সেখানেই লেখাপড়া চলতো। গ্রামের লোকজনের সাহায্যে নল খাগড়া আর ছনের চালার স্কুল ঘরটি উঠতে দু’ তিন মাস সময় লেগে যেত। সেটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। সেরা শিক্ষালয়। অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজ বলতে আমি সেই নল খাগড়া আর ছনের চালা ঘরের স্কুলকেই বুঝি।

আজকাল কত জাতের স্কুল গড়ে উঠেছে। দেশে এনজিও পরিচালিত স্কুলের সংখ্যাও কম নয়। ব্র্যাক নামক এনজিও’র শিক্ষা কার্যক্রম সত্যি প্রশংসার দাবিদার। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই মাত্র কয়েকদিন আগে পরলোকগমন করেছেন। সারা দুনিয়া জুড়ে তার নামধাম। কেন যে তিনি নোবেল পুরস্কারটি পাননি-সে আমার অনেকদিনের দুঃখ। তবে নোবেল কমিটি মরণোত্তর হলেও তাঁকে একদিন এই পুরস্কারে ভূষিত করবে বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। নোবেল পুরস্কার তাঁকে দিলে পুরস্কারটির ভাবমূর্তি আরও বাড়বে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ সেটি পাওয়ার যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করেছেন। সেটি দিয়ে তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং পুরস্কারটির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।

ব্র্যাকসহ অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা কার্যক্রম তাদের মুখ্য কোনো কর্মসূচি নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি তাদের সহায়ক কার্যক্রম। মূলত দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষুদ্র আয়ের মানুষজনকে বিভিন্ন রকম সহায়তা দিয়ে তাদের জীবন মান কিছুটা হলেও উন্নত করা এসব বেসরকারি সংস্থার মূল উদ্দেশ্য থাকে। এটি তাদের প্রধান কাজ, মুখ্য কর্মসূচি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কিংবা এ জাতীয় কর্মসূচিতেও তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে তাদের শিক্ষা কিংবা শিক্ষকের মান উন্নত। আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহোদয় কেন যে এই বিতর্কটির জন্ম দিয়েছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তার কথায় প্রাথমিকের শিক্ষকরা মনে কষ্ট পেয়েছেন, মর্মাহত হয়েছেন, বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের সহকারী ও প্রধান শিক্ষকদের ১১তম ও ১০ম গ্রেড নিয়েও নাকি তিনি কী যেন কী উল্টা পাল্টা কথা বলেছেন? সেই কষ্টটি ভুলতে না ভুলতে আরেক কষ্ট তাদের চরম ব্যথিত করেছে।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর হয়তো জানা নেই যে, প্রাথমিক শিক্ষকরা হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের প্রথম হাতিয়ার। বঙ্গবন্ধুর একান্ত আস্থা ও বিশ্বাসের পাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ। তাই জাতির জনক যুদ্ধ বিধ্বস্থ অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করেছিলেন। আজ সে সব শিক্ষকের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার করার শামিল।

বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করে দিয়ে যাওয়ার কারণে তা আজ অনেকটা বিশ্ব মানে উন্নীত হতে পেরেছে। যোগ্যতা সম্পন্ন এবং একাডেমিক ব্যাক গ্রাউন্ড অনেক ভালো- এমন উচ্চ শিক্ষিতরা আজকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসছেন। অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা অনায়াসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এগিয়ে আসছেন। আমি প্রাইমারি স্কুলে যে শিক্ষকের কাছে পড়ালেখা করেছি, তিনি হাই স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারেননি। তাকে সবাই নন ম্যাট্রিক বা আন্ডার মেট্রিক বলতো। শিক্ষার্থী সংখ্যা কম হলেও তিনি একা পাঁচটি ক্লাস সামাল দিতেন। আজ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। প্রতিটি স্কুলে পাঁচ-সাত জন করে শিক্ষক। সকলে বিএ, এমএ পাস। অনেক উন্নত ও ভালো মানের প্রশিক্ষণ তারা পাচ্ছেন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু হয়েছে। শিশু শ্রেণির ভেতরের সাজগোজ কতই না চমৎকার! আগেকার দিনে বিদেশের শ্রেণিকক্ষের কথা যেমন শুনতাম, ঠিক তেমনি।

আমি ঢালাওভাবে সকল শিক্ষকের কথা বলি না। তবে প্রাথমিকের বেশিরভাগ শিক্ষকই আজ অনেক আপ-টু-ডেট। তারা নিবেদিত প্রাণ হয়ে আমাদের প্রজন্মকে গড়ে তুলেন। শিশু শিক্ষার্থীদের পরম স্নেহ মমতা ও আদর দিয়ে পরিচর্যা করেন। মানুষের মতো মানুষ হবার স্বপ্নের বীজটি শিশুর মনে তারাই রোপন করে দেন। একটা শিশু শিক্ষার্থীকে সারাদিন স্কুলে ধরে রাখা চারটেখানি কথা নয়। একেকটা স্কুলে চার-পাঁচশ’ শিশু শিক্ষার্থী। ব্র্যাক কিংবা অন্য যে কোনো বেসরকারি সংস্থার স্কুলে কয়জন শিশু লেখাপড়া করে? এদের শিক্ষার্থী সংখ্যা সীমিত থাকে। শিক্ষক দু’ তিন জন থাকেন এবং তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেকটা সীমিত থাকে। এনজিওগুলো অনেক সময় এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস বেকারদের কর্মসংস্থান দিয়ে তাদের বিশেষায়িত স্কুলগুলোতে চাকরি দিয়ে থাকে। তাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মানের বিষয়টি সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। সরকারি প্রাথমিকে যারা শিক্ষকতায় আসেন, তারা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এসে থাকেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের চেষ্ঠায় প্রাথমিক শিক্ষা আজ শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে আমাদের গোটা শিক্ষায় যেটুকু উন্নতি পরিলক্ষিত হয়, সেটুকু সম্ভব হয়েছে। আজ শিশু শিক্ষার্থীরা পিইসির মতো একটি পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার সাহস পাচ্ছে। এর উপর ভিত্তি করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। দিনে দিনে আমাদের শিক্ষা বিশ্ব মানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

আমি প্রাথমিকের শিক্ষকদের সাফাই গাই না। সব শিক্ষক একদম আপডেট কিংবা পারফেক্ট-সেও বলি না। আবার এনজিও শিক্ষদেরও হেয় চোখে দেখি না। তাদের মাঝেও নিবেদিত প্রাণ অনেকেই আছেন। কিন্তু কেউ যখন প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশেষায়িত স্কুলের বা এনজিও স্কুলের শিক্ষকের সাথে তুলনা করে, তখন বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টি হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার কারিগরদের হেয় করার মানসিকতা কেউ দেখালে তার প্রতিবাদ অটোমেটিক চলে আসে। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষকদের ভালোবেসে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্ম বার্ষিকীতে এ অহেতুক বিতর্ক কেন?

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।  


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042459964752197