প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, লেখাপড়ার জন্য শিশুদের অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত নয়। তাদের ভয় দেখিয়ে কখনো লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। খেলার ছলে আনন্দ দিয়ে তাদের শিক্ষা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, শুধু শিক্ষা নয়, সেই সঙ্গে শিশুরা যাতে খেলাধুলা করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে শিক্ষকদের। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক গঠনও যেন হয় সেদিকে যত্ন নিতে হবে।

২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ মেধা সম্পন্ন জাতি গঠনে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায় মানসম্মত ও জীবনমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। লেখাপড়ায় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের ফলে শিক্ষার্থী সংকটে আজ অনেক প্রাথমিক স্কুলের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে। প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জন। এ সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সারা দেশে ৬২৫টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনের নিচে, ২৫টিতে ২০ জনের নিচে, অসংখ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০ জনের নিচে। ৫ মার্চের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড়শ জনে উন্নীত করার জন্য অফিস আদেশ জারি করেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা ক্যাচমেন্ট এলাকায় শতভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে শিক্ষকদের দুর্বল হোম ভিজিট ও কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলাকে চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষার্থীকে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি করবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব অভিভাবকের। সংশ্লিষ্টদের কাজ হবে হোম ভিজিট ও পরিদর্শনের পাশাপাশি অভিভাবকদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যালয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করা। অথচ তারা উল্টো পথে হাঁটছে। উন্নত বিশ্বে শিশুদের বিদ্যালয়ে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করানো হয়। সেখানে কোনো পরীক্ষার যন্ত্রণা নেই। শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনই মুখ্য। আর আমাদের বিদ্যালয়ের পরিবেশ তার বিপরীত। আমাদের দেশে জ্ঞান অর্জন যাচাইয়ের জন্য মূল্যায়নের পরিবর্তে পরীক্ষার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যার ফলে নোট, গাইড ও কোচিংয়ের ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে বড় বড় সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতরা পরীক্ষায় ভালো পাসের জন্য তাদের সন্তানদের অতিরিক্ত চাপ দিয়ে থাকেন। তারা সন্তানদের বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বই না পড়িয়ে অতি অল্প সময়ে জ্ঞানী বানাতে চান। 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবে পরিণত করতে শিশুর ওপরে অহেতুক চাপ কমানোর জন্য জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানো নিষিদ্ধ করতে হবে। সকল শিশুর জন্য অভিন্ন বই হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংকট অনেকটা দূর হবে।
 
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা অনেকটা কারাগারে অবস্থান করছেন। বিরামহীন ৯টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ক্লাস করে যাচ্ছেন। এখানে নেই কোনো বিনোদন। শুধু পড়া আর লেখা। স্কুলগুলোতে শিশু শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বিনোদনের তেমন সুযোগও নেই। 

বিকালে খেলাধুলা, সকালে একটু হাঁটাহাঁটি বা আরবি পড়ার অভ্যাস শিশুদের মাঝ থেকে অনেকটা হারিয়ে গেছে। অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সাধারণত তাদের বাবা-মাকে পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করে থাকে। প্রাথমিকের সময়সূচি সেসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তারা টাকা খরচ করে হলেও কিন্ডার গার্টেন স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করেন। এ ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব অভিন্ন কর্মঘণ্টা প্রণয়ন ছাড়া প্রাথমিকে শিক্ষার্থী সংকট দূর করার বিকল্প নেই।

সন্তান মা-বাবার। তাদের ইচ্ছার বাইরে অবাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিলে সরকারি করা বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে। এর দায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর। এছাড়া শিক্ষক সংকট দূর করা ও তাদের আন্তরিক করতে শিক্ষকদের সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধানের বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারি করা হয়েছে। কিন্তু অবাস্তব কোনো সিদ্ধান্ত নিলে এ পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। 

শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার সুবিশাল ভবন ও ভৌত অবকাঠামো তৈরি করেছে। শিক্ষার্থী সংকটে তা অনেকটা ‘উপর দিয়ে ফিটফাট, ভেতরে সদর ঘাট’ প্রবাদের মতোই। এ সংকট থেকে অব্যাহতি পাওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিবে। সরকারি করা বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সুনামের সাথে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে সমাধান করার প্রত্যাশা আমাদের। 

লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061938762664795