প্রাথমিকে রমজানের ছুটি বিড়ম্বনা

মো: সিদ্দিকুর রহমান |

প্রাথমিকে ছুটির মধ্যে পাঠদানবহির্ভূত কাজের যন্ত্রণা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেকটা কানে সিসা লাগিয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ব্যাহত করে চলছে। এভাবে তারা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষতি তথা সরকারের সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে চলছে। তাদের র্কীতি হলো প্রাথমিকে নোট, গাইড, কোচিংয়ের প্রসার করা, শিক্ষকদের যৌক্তিক সমস্যা বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা এবং সহকারী ও প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য সৃষ্টি করে শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা।

শিক্ষিত সমাজ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায়। সবার ওপরে  থাকবে শিক্ষকের মর্যাদা-- এ বোধটুকু শিক্ষক নেতাদের মাঝে দৃশ্যমান নয়। কেবল নেতৃত্ব জাহির, তোষামোদ করে বদলিসহ নানা কাজে ঘুষ বা চাঁদা আদায়ের দৃশ্য ছাড়া  শিক্ষকদের দাবি আদায়ের জন্য সংগঠিত করার দৃশ্য খুব একটা নজরে আসে না। ফেসবুকে কর্তা ব্যক্তি বা মন্ত্রীদের সাথে ছবির দৃশ্য ভেসে আসে।

এ বছর রমজানের ছুটি নিয়ে ভাবনা যেন কারো নেই। পাকিস্তান আমল থেকে রমজান মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে দেখে আসছি। আজও এ ধারা অব্যাহত আছে। প্রাথমিকে বছরে সর্বমোট ছুটি ৭৫ দিন। উচ্চ বিদ্যালয়ে বা কলেজে  ছুটি ৮৫ দিন। বছরে  এত ছুটি দেখে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, প্রাথমিক শিক্ষকরা সকল কর্মচারীদের মধ্যে বেশি  আরাম আয়েশে আছেন। কিন্তু এ আরাম অনেকটা হারাম করে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা। 

ছুটি হরণের বিভিন্ন কাজ,  যেমন ভোটার তালিকা , ভোট গ্রহণ , আদমশুমারিসহ অনেক শুমারি ,বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলায় শিক্ষার্থীসহ ৪/৫ দিন দর্শকের সারিতে অবস্থান, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিভিন্ন কর্মকর্তা মন্ত্রীদের সভায় যোগদান, উপবৃত্তি টাকা বিতরণ কর্মকাণ্ডসহ নানা কাজে শিক্ষকদের নির্ধারিত ছুটির ৭৫ দিন অনেকটাই হারিয়ে যায়। সরকারি  কর্মচারীদের বাৎসরিক  ছুটি বছরে ২৪/২৫ দিন । সপ্তাহে শুক্র, শনি ২ দিন ছুটি থাকায় তাদের ছুটি ৫২+২৫= ৭৭ দিন বা ২/৪ দিন কম বেশি।উচ্চ বিদ্যালয়ে কলেজসহ সরকারি কর্মচারীদের পাঠদান সংশ্লিষ্ট বা বর্হিভূত তেমন কাজ নেই।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শিক্ষায় রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। এ বৈষম্য ছুটির ক্ষেত্রেও। সরকারি ছুটির দিবসগুলো এক থাকলেও  রমজানের ছুটি, ঈদের ছুটি, গ্রীষ্মকালীন ছুটি, শীতকালীন ছুটিসহ বড় ধরনের ছুটিগুলোর মধ্যে তফাৎ বিদ্যমান। যেমন প্রাথমিকে এবারের রমজানের ছুটির পর ঈদের পরের দিন স্কুল খোলা। সংশ্লিষ্টদের এ দৃষ্টিভঙ্গি সকলকে হতবাক করে দিয়েছে। ঈদের উৎসব সর্বজনীন। সাধারণত পারিবারিক পরিমণ্ডলে পাড়া প্রতিবেশী আত্নীয়স্বজন নিয়ে  সকলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে থাকে। সংশ্লিষ্টরা হয়ত এ আনন্দকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যাপকভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মানসে ঈদের পরের দিন স্কুল খোলা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতির জনকের জন্মদিন বা শিশু দিবস , ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসসহ অন্যান্য দিবসে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছুটি রেখে দিবসগুলো পালনের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়।

যার ফলে স্বল্প শিক্ষার্থীকে টেনে এনে  শিক্ষকেরা যেন তেন ভাবে দিবসগুলো পালন করে থাকেন। ঠিক তেমনিভাবে ঈদের পরের দিন সরকারি কর্মচারী বিধায় শিক্ষকেরা উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতির বিষয়টি কেমন হবে, বিষয়টি সকলে ভেবে দেখবেন। কর্তৃপক্ষের অদ্ভুত সিদ্ধান্তগুলো যখন স্কুল খোলা রাখার কথা, তখন বন্ধ রাখে। আর যখন বন্ধ রাখার কথা তখন খোলা রাখে। ছুটির তালিকা প্রণয়নের পূর্বে  প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ গণশুনানি বক্তব্যে বলেছিলাম, জাতীয় দিবসসহ  বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  দিবস পালনের জন্য উক্ত দিবসগুলোতে বিদ্যালয় খোলা রাখা। বিদ্যালয়ে ছুটি রেখে যেন তেনভাবে দিবস পালন না করা। প্রাথমিক শিক্ষকদের ৩ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তি সরকারি নির্দেশ। এ ভাতা খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করে ৪/৫ বছর পরে দেয়া সরকারি আদেশের পরিপন্থি ও শিক্ষকদের অধিকার হরণ।

আরবি ও ইংরেজি  বছরের পার্থক্য প্রতি বছরে ১০ দিন। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বছর রমজান মাসের ছুটিকে শ্রান্তি বিনোদন ছুটি দেখিয়ে ভাতা দেয়া হয়।রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো পর্বে ১৫ দিন ছুটি না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষকদের ৪-৫ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেতে হচ্ছে।  প্রাথমিক শিক্ষকদের বার্ষিক ছুটি ৭৫ দিন ঠিক রেখে গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন রাখা হলে তারা শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৩ বছর পর পর পেতেন। সাধারণত গ্রীষ্মের ছুটি ৫-৭ দিন তালিকা রাখা হয়। জাতীয় দিবস বা বিশেষ দিবসে বিদ্যালয় খোলা রেখে ছুটি ও কম গুরুত্বপূর্ণ ছুটি কমিয়ে ১৫ দিন গ্রীষ্মের ছুটি করা হলে  প্রাথমিক শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৩ বছর পর পর পেতে কোনো সমস্যা হতো না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আবেদন মোতাবেক ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ সময়  গ্রীষ্মের ছুটি রাখা হতো। বিগত কয়েক বছরে গ্রীষ্মের ছুটি কম রাখায় সরকারি আদেশ লঙ্ঘনসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। গণশুনানিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নজর আনা ও সংবাদপত্রে বিষয়টি লেখালেখির পরেও ফলাফল দাঁড়ালো গ্রাম্য প্রবাদের মত যে লাউ সেই কদু।

আগামী প্রজন্মকে দেশাত্মবোধ নিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আজকের দিনে অতীব জরুরি।অভিভাবকের একাধিক সন্তানের মধ্যে কেউ প্রাথমিকে, কেউ উচ্চ বিদ্যালয়ে অথবা অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। ছুটির ভিন্নতার কারণে বড় অবকাশগুলো তারা নির্বিঘ্নে উপভোগ করতে পারে না। অবকাশগুলো উদযাপন করার জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকা সমন্বয় করার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। প্রাথমিকে ঈদের পরদিন স্কুল খোলা ও শ্রান্তি বিনোদন ভাতা তিন বছর পর পর প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য প্রাথমিক  শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্রুত সমাধান কামনা করছি।

 

 মো. সিদ্দিকুর রহমান:  আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028889179229736