প্রাথমিকের শিক্ষকদের নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর ভগ্নাংশের অঙ্ক

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার ভিত্তি। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে শিক্ষিত খেতাব পেতে হয়। প্রাথমিকের শিক্ষকেরা শিক্ষিত নাগরিক তৈরির প্রথম কারিগর। ছোট শিশুকে নিয়ে পুরো পরিবার থাকে ব্যস্ত ও সতর্ক। সকলের দৃষ্টি থাকে শিশুর ওপর। সে অবুঝ শিশুকে অনেকটা প্রাণীর সাথে তুলনা করা যায়। অসংখ্য শিশুর অন্তরে থাকে প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান। কারণ তাদের মানব শিশুতে রূপান্তরিত করার কঠিন কাজটির দায়িত্ব প্রথমে প্রাথমিকের শিক্ষকেরাই নিয়ে থাকেন।

প্রাথমিকের শিক্ষকেরা বিরতিহীনভাবে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত পাঠদান করান। এ সময়ের পরে হোম ভিজিটসহ তাদের অসংখ্য পাঠদান বর্হিভূত কাজ করতে হয়। উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য কোনো সরকারি, বেসরকারি কর্মচারীর পাঠদান বর্হিভূত কাজ নেই। শিক্ষক সংকটের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে অনেক সময় দৌড়ের ওপর একসাথে একাধিক ক্লাস করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। এ সংকট দূরীকরণে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ বেড়েই চলছে।

শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর পরই আবার সৃষ্টি হয় শূন্য পদ। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকটা ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা’ গানের মতো। প্রাথমিকে অসংখ্য কর্মকর্তাসহ ১১ ধরনের কমিটির দেখভাল প্রাথমিকের শিক্ষকেরা হয়ে পড়ে দিশেহারা। শিশুদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হ্রাস করে তাদের সময় ম্যানেজ করতে হয়।

এত কিছুর পরও বিগত দশকে প্রাথমিক শিক্ষা ছুটছে তার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির পথে। চ্যালেঞ্জ করে বলতে হয়, বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ব্র্যাক কিন্ডারগার্টেন হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখার শিক্ষার্থীর চেয়ে জ্ঞান অর্জনে অনেক এগিয়ে। এর প্রধান কারণ, শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষা নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও তরুণ মেধাবী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকদের আন্তরিকতার প্রয়াস। বিশেষ করে বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের আন্তরিক উদ্যোগে বিগত সময়ের তুলনায় শিক্ষকদের নিয়মিত ও সময়মতো আগমন প্রস্থান অনেকটা সফলতা লাভ করছেন। সকল প্রকার অনিয়ম প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় এখন সুবাতাস বইছে। এ সত্বেও মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইদানিং প্রদত্ত বক্তব্যে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে কাঙ্গালিনী সুফিয়ার গানের ভাষায় বলতে হয় ‘আমি বুড়ি হইলাম, তোর কারণে’। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্র্যাকের শিক্ষকদের সাথে ভগ্নাংশের অবতারণা করে শুধু শিক্ষক সমাজকে হেয় করেন, শিক্ষাবান্ধব সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজেকে সমালোচনার মাঝে ঠেলে দিয়েছেন।

ব্র্যাকের কর্মরত শিক্ষকেরা স্বল্পসময়ে শিক্ষাদান করে থাকেন। তাঁদের শিক্ষক সংকট ও পাঠদান বর্হিভূত কোনো কাজের চাপ নেই। ব্র্যাক এ দেশের দরিদ্র জনগণের শিক্ষার জন্য কাজ করে আসছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ব্র্যাকের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ব্র্যাকের শিক্ষকমণ্ডলী এসএসসি, এইচএসসি পাস হলেও জবাবদিহিতার মাঝে তাঁরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তদুপরি, ব্র্যাকের শিক্ষকদের যত সাফল্য থাকুক না কেন, কোনো অবস্থাতে প্রাথমিকের বর্তমানের ১ দশকের সাফল্যের সাথে তুলনা করা সঠিক নয়। তবে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ব্র্যাকের ১ জন শিক্ষকের সাথে প্রাথমিকের ৪ জন শিক্ষকের সাথে তুলনা করেছেন, তা বোধগম্য নয়।

বঙ্গবন্ধু ও শিক্ষাবান্ধব সরকারের সরকারিকৃত প্রাথমিক শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করে ব্র্যাক ও কিন্ডারগার্টেনকে পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিভাবক হিসেবে কতটা যৌক্তিক? যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের খেলাধুলার ও বইয়ের চাপ কমিয়ে আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদানের কথা বলে আসছেন, সেখানে মন্ত্রণালয় কিন্ডারগার্টেনে বইয়ের চাপ কমানোর বিষয়ে নিরব থেকে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

বেশি বেশি বই পড়ানোকে আমাদের দেশের অভিভাবকেরা বেশি জ্ঞান অর্জন মনে করে। এ ভ্রান্ত ধারণার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে আগ্রহী হন না। অপরদিকে সময়সূচির বৈষম্যের ফলে অনুরুপভাবে কিন্ডারগার্টেন, ব্র্যাকসহ বেসরকারি প্রাথমিকে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখা ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ প্রতিষ্ঠানলগ্ন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। বার বার প্রাথমিকের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলে আসছেন, প্রাথমিক শিক্ষকেরা বেশি বেতন পান। প্রাথমিক শিক্ষকেরা বর্তমান সরকারের আমলে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর চেয়ে বর্ধিত বেতন পেয়ে থাকেন। সম্মাানিত সংসদ সদস্য, মন্ত্রীসহ সকলেই বর্ধিত বেতন পেয়ে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের দাবিকে আড়াল করার অভিপ্রায় বেশি বেতন পায় বক্তব্য ষড়যন্ত্রের অংশ।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আপনার ভগ্নাংশের অঙ্কে প্রাথমিক শিক্ষকসহ প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সকলের অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। প্রাথমিকের শিক্ষার উন্নয়নের সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষাবান্ধব সরকারের পাহাড়সম সাফল্যকে হেয় করে আপনি অহেতুক ব্যর্থতার দায় নিজের ওপর নিয়েছেন। শিক্ষকের মর্যাদার সাথে শিক্ষার উন্নয়ন জড়িত। হয়তো গুটিকয়েক শিক্ষকের জন্য মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর এই ভগ্নাংশের ধারণা। তারা আপনারই মন্ত্রনালয়ের অধীনে কর্মরত। তাদের যথাযথভাবে ঠিক করার দায়িত্বে আপনি সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কারো ব্যর্থতার দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষাবান্ধব সরকারকে বিতর্কিত করা মোটেই বাস্তব সম্মত নয়। 

অসংখ্য সফলতার মাঝে শিক্ষাবান্ধব সরকারের বিশাল অর্জন ক্ষুণ্ন হতে পারে না। বাস্তবে কারো যোগ, বিয়োগ শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে না। মর্যাদা হ্রাস পাবে, তাদের কর্মে। মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার ‘শিক্ষক হউক জ্ঞান প্রসারের হাতিয়ার’। শিক্ষকের সম্পর্কে সকলের মাঝে ভালোবাসা জাগ্রত হউক, এ প্রত্যাশা করছি।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030851364135742