ফিনিশদের শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি অব হেলসিংকি’-তে আমার এক ছাত্র পিএইচডি করছে। গত ডিসেম্বরে দেশে বেড়াতে আসে সে। তার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘হাতেখড়ি’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হয়। সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ম্যাগাজিনটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এ সময় প্রত্যেক অতিথির হাতে একটি করে কপি দেয়া হয়। সে সুবাদে অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই এটি হাতে পেয়ে যাই। পুরো ম্যাগাজিনটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে এক নজর পড়ে ফেলি। এক জায়গায় গিয়ে পিএইচডি গবেষক আমার ছাত্রের লেখা ‘পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ ফিনল্যান্ড ও এর শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি চোখে পড়ে। একদিকে ইউরোপের একটি দেশ ও তার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা এবং অন্যদিকে প্রবন্ধটির লেখক আমার একজন প্রিয় ছাত্র হবার কারণে লেখাটির প্রতি কৌতূহল বেড়ে যায়। সেটি তাই মনযোগ দিয়ে পড়ি। অনুষ্ঠান চলাকালীন মঞ্চে বসেই পড়া শেষ করি। আজ সে বিষয়ে কিছু একটা নিজের মতো করে লেখতে বসেছি।

এ লেখাটি লিখতে বসে বার বার কেবল আফসোস হচ্ছে- আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি এদের মতো হতো। এ প্রশ্নটিও মনে জেগে ওঠে যে, জানি না কোনদিন আমাদের শিক্ষাটি তাদের মতো হবে? আশায় বুক বাঁধি এ কারণে যে, শ্লেট, পেন্সিল আর চক ডাস্টারের যুগ পেরিয়ে আমরা এখন স্মার্ট বোর্ড ব্যবহার করতে শুরু করছি। স্মার্ট ক্লাসে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস এখন প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল হাজিরা শিক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনলাইন ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, ফি পরিশোধ, ফল প্রকাশ প্রভৃতি আমাদের শিক্ষায় ডিজিটেলাইজেশন তথা অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত একদম ফ্রি পাঠ্য বই পাচ্ছি। সেটি কম কিসে? তথাপি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশ থেকে আমরা কত যে পিছিয়ে আছি, তা ফিনিশদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে একটু আলোকপাত করলে স্পষ্ট বুঝা যায়।

আগেই বলেছি, আজকের লেখাটি আমার পিএইচডি গবেষক ছাত্রের লেখার অনেকটা কার্বন কপির মতো হবে। এবার তারই লেখার অনুসরণে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। পাঠকদের সুবিধার জন্য প্রথমে দেশটির ভৌগোলিক পরিচয় দেয়া সমীচীন মনে করি। এটি উত্তর ইউরোপের একটি দেশ। নরওয়ে, সুইডেন ও রাশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষে এর অবস্থান। দেশটির অধিবাসীদের ‘ফিনিশ’ বলা হয়। এর জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ, যদিও এটি আয়তনে আমাদের দেশ অপেক্ষা আড়াইগুণ বড়। দেশটির রাষ্ট্রীয় ভাষা ফিনিশ এবং সুইডিস হলেও শতকরা ৯০ জন মানুষ চমৎকার ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে। এটি পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপূর্ণ ও অপরাধমুক্ত দেশ। দেশটিতে কেউ কোনো অপরাধ করে না বললেই চলে।

বিশ্বের সবচেয়ে উত্তম শিক্ষাব্যবস্থাটি ফিনল্যান্ডে গড়ে উঠেছে। PISA-র (Programme for International Student Assessment) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সেরা শিক্ষাব্যবস্থার খেতাবটি ফিনল্যান্ড দখল করে বসে আছে। তাই, সারা দুনিয়ার শিক্ষা গবেষকদের কাছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত আগ্রহের একটি বিষয়।

ফিনল্যান্ডের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই একদম ফ্রি। দেশটিতে শিক্ষার হার শত ভাগ। অশিক্ষিত বা নিরক্ষরের কোনো নামগন্ধ নেই। যে কোনো শিশুর বয়স ৩ বছর হলেই তাকে ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ নামের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখানে সে খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো এবং আধো আধো কথা বলা শিখে থাকে। এরপর ৬ বছর বয়স থেকে প্রাইমারি স্কুল শুরু হয়। আমাদের দেশের মতো তাদের শিশুদের গাদা গাদা বইয়ের বোঝা নেই। মধ্যাহ্ন ভোজ, বই, খাতা, কলম, শিক্ষা সফর, স্কুলে যাতায়াত-সব কিছু তারা বিনা মূল্যে পেয়ে থাকে। তাদের স্কুলগুলোতে কোনো পরীক্ষা নেই। কেবলমাত্র ১৬ বছর বয়সে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর শেষ করে তারা একটি আবশ্যকীয় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। অবশ্য শিক্ষকরা ইচ্ছে করলে শ্রেণিতে ছোট-খাট টেস্ট নিতেই পারেন।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তাদের স্কুল টাইম আমাদের মতো দীর্ঘ নয়। তাদের স্কুলের দৈনন্দিন কার্যক্রম সকাল ৯ টায় শুরু হয়ে দুপুর ২ টায় শেষ হয়ে যায়। একই স্কুলে একেক দিন একেক সময় শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়। এ নিয়ে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ফিনল্যান্ডের জনসাধারণ মনে করে, সকাল ৯ টার আগে কোনোভাবেই স্কুলের কার্যক্রম শুরু করা ঠিক নয়। স্কুলে দৈনিক ৩ থেকে ৪ পিরিয়ড ক্লাস হয়ে থাকে। প্রতিটি পিরিয়ডের দৈর্ঘ্য ৭৫ মিনিটের কম হয় না। প্রত্যেক পিরিয়ডের পর ১৫-২০ মিনিট বিরতি দেয়া হয়। বিরতির সময়ে শিক্ষার্থীরা পড়া আত্মস্থ করে। কেউ কিছু সময় হাঁটা চলা বা গল্প-গুজব করে। এরপর পুরো উদ্যম নিয়ে পরের ক্লাসে যায়। তাদের প্রতিটি শ্রেণিতে ১৫ থেকে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকে না। শিক্ষকেরা তাদের তেমন কোনো হোমওয়ার্ক দেন না। তাই আমাদের শিশুদের মতো ফিনল্যান্ডের শিশুদের হোমওয়ার্কের পেছনে এত সময় ব্যয় করতে হয় না।

ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে শিশুদের লেখাপড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই মর্মে একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, শিশুদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতাসহ একুশ শতকের দক্ষতাগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। তাই তাদের কারিকুলাম থেকে অঙ্ক, বিজ্ঞান, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে যে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা সৃষ্টি করার শিক্ষা দেয়া হয়।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষায় সাম্প্রতিক সংযুক্তি হলো-Phenomenon Based Learning. এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো অধ্যায়ের পরিবর্তে একটিমাত্র অধ্যায় ৬ সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন আঙ্গিকে পড়তে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীগণ নিজেরাই তাদের প্রশ্ন তৈরি করে এবং নিজেরাই উত্তর খুঁজে বের করে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক পদ্ধতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ কারণে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সামর্থের শিক্ষার্থীরা একই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে থাকে। কোনো শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট কাজ করতে না পারলে শিক্ষক তার জন্য স্বতন্ত্র্য পরিকল্পনা করে থাকেন এবং তার জন্য আলাদা অন্য কোনো কাজ ডিজাইন করে দেন। শিশুরা তাদের পছন্দ ও সামর্থের উপর ভিত্তি করে শ্রেণির কাজ নির্বাচন করার সুযোগ পায়। শ্রেণির পাঠে মন না বসলে শিক্ষার্থীরা পছন্দ মতো বই পড়তে কিংবা দোলনায় দুলতে পারে। চেয়ার কিংবা বেঞ্চে শিক্ষার্থীর বসা বাধ্যতামূলক নয়। তারা চাইলে সোফায় বসে কিংবা মেঝের কার্পেটে শুয়েও ক্লাস করতে পারে। শিক্ষকেরা মনে করেন, শিশুদের বাসায় বিশ্রাম নেয়া এবং পরিবারের লোকজনের সাথে বেশি সময় কাটানো দরকার। তাই তাদের হোমওয়ার্ক তেমন একটা দেয়া হয় না। দিলেও তা খুব মজার হয় এবং একদম স্বল্প সময়ে করা যায়।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশা খুব আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক। শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে বেশি। নিয়োগ প্রক্রিয়াও খুব বেশি প্রতিযোগিতামূলক ও কঠিন। শিক্ষার্থীদের পছন্দ ও অপছন্দের উপর শিক্ষকের চাকরি থাকা বা না থাকা নির্ভর করে। শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয় না। একেকটা কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়া হয়। যিনি ভালো পড়ান, তার চাকরি পুনরায় নবায়ন করা হয়। আর যিনি ভালো পড়ান না, তার চাকরি পরবর্তী কোর্সের জন্য নবায়ন করা হয় না। যারা ভালো ছাত্র ছিলেন, নিয়োগের সময় কেবল তাদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তাই ফিনল্যাণ্ডে চাইলেই যে কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। শিক্ষকতায় গবেষণার মূল্য দেয়া হয় সর্বাধিক। ফিনল্যান্ডে একজন প্রাইমারি শিক্ষকের  ন্যূনতম যোগ্যতা হচ্ছে শিক্ষকতা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা।

প্রাইমারি স্কুলগুলোতে জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো শিখিয়ে দেয়া হয়। সাঁতার, রান্না, সেলাই, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা, সময়ের সাথে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য যে দক্ষতাগুলো অর্জন করা দরকার, সেগুলো তাদের স্কুলেই শেখানো হয়। মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীরা স্লিপিং ব্যাগ সাথে নিয়ে স্কুলে যায়। তারা শিক্ষকদের সাথে সারারাত ধরে মুভি দেখে, খেলাধুলা করে এবং এক সময় ক্লান্ত হলে ঘুমিয়ে পড়ে। অতঃপর সকালে ঘুম থেকে উঠে শিক্ষকের সাথে প্রাতঃরাশে অংশ নেয়। আইসক্রিম খায়। এ রকম আরও নানা মজার ব্যাপার স্কুলগুলোতে থাকে। এ কারণে তাদের স্কুলগুলোতে পড়াশুনার চমৎকার ও আনন্দময় পরিবেশ যেমন থাকে, তেমনি করে প্রতিটি শিশু নিশ্চিত করে শেখার সুযোগ পায়। তাই, তাদের স্কুলগুলোতে ‘ভালো ছাত্র’ কিংবা ‘খারাপ ছাত্র’ বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হবার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি শিক্ষার্থী তার নিজের মতো করে সৃজনশীলতা দেখাবার অবারিত সুযোগ লাভ করে থাকে।

ফিনল্যাণ্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে পিএইচডি গবেষণারত আমার প্রিয় ছাত্রটির জন্য অবিরত শুভ কামনা জানিয়ে আজ লেখাটি এখানেই শেষ করতে চাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি ফিনল্যান্ডের আদলে ঢেলে সাজাবার উদ্যোগ নেবার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতেই পারে। মধ্যম আয়ের দেশ পেরিয়ে উন্নত দেশে যাবার আগেই আমাদের সেটি করা উচিত।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006072998046875