বন্ধুবৎসল তবে বন্ধু নয়

ড. এস এম ইমামুল হ ক |

শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষাদানের মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন একেকজন আদর্শ শিক্ষক। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলেন।

প্রশ্ন হল, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? শিক্ষক ছাত্রদের স্নেহ করবে, তেমনি ছাত্র শিক্ষককে শ্রদ্ধা করবে। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক কেবল গুরু-শিষ্যের নয়। একজন ছাত্র অনেক কথা মা-বাবাকে বলতে পারে না।

শিক্ষকরা সহানুভূতিশীল ও বন্ধুসুলভ হলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাছে অনেক মনের কথা বলতে পারে। শিক্ষক অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারেন। এ কারণেই শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেল হন শিক্ষকরা।

শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা বিতরণ নয়, মানুষ হয়ে ওঠার জন্য ছাত্রছাত্রীদের যা যা প্রয়োজন, সবকিছু ইনপুট তাকে দেবেন। দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে বলবেন, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করবেন, পরিবেশ সম্পর্কে বলবেন।

আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থী বাসায় কিছু বলতে পারে না, সেগুলো অকপটে শিক্ষকের কাছে বলতে পারে। সে কারণে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মধুর হওয়া দরকার। আমরা যতই বলি, শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভালো না হলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হবে না, ছাত্ররা প্রকৃত শিক্ষাটা পাবে না। একজন শিক্ষক ছাত্রের গাইড। সুতরাং তাকে সেভাবে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। ছাত্ররা যেন বোঝে মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান।

আমি আমার কলিগদের বলি, ক্লাস এক ঘণ্টা হলে সেখানে অন্তত ১০ মিনিট রাখতে হবে, যেখানে বইয়ের বাইরের কথা বলা হবে। এতে ছাত্ররা শিক্ষকদের অনেক কাছে চলে আসে। একজন ছাত্র হয়তো মানসিক অশান্তিতে ভুগছে, রেজাল্ট খারাপ করছে।

এর অনেক কারণ থাকতে পারে। সে মাদকাসক্ত হতে পারে, তার পারিবারিক সমস্যা থাকতে পারে, অর্থনৈতিক সমস্যা থাকতে পারে, প্রেমঘটিত বিষয় থাকতে পারে। কারণটি খুঁজে বের করা শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার পরিবেশ থাকলে শিক্ষার্থীরা খুব ভালো সমাধান পেতে পারে।

শ্রেণীকক্ষের বাইরেও ছাত্র-শিক্ষক যোগাযোগ থাকা উচিত। কোনো ছাত্র হয়তো লেখালেখিতে ভালো, তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেউ ভালো গান গায়, কেউ খেলাধুলায় ভালো, কেউ বিতর্ক করতে পছন্দ করে, এসব বিষয়ে শিক্ষকদের গাইড করতে হবে। তাই ক্লাসরুম ও ক্লাসরুমের বাইরে- দুই জায়গায়ই শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।

শিক্ষকদের অবশ্যই বন্ধুবৎসল হওয়া উচিত; কিন্তু বন্ধু নয়। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশি খোলামেলা হয়ে যান। আমি মনে করি, এটি ঠিক নয়। তবে ছাত্রদের সঙ্গে কখনও আনফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করা উচিত নয়। মাস্টার্স লেভেলে শিক্ষার্থীরা ম্যাচিউরড হয়, তারা অনেক কিছু বোঝে। তখন তাদের সঙ্গে অনেকটাই ফ্রেন্ডলি হওয়া যায়, অনেক কথা বলা যায়।

আদর্শ শিক্ষক হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। অনেকের ধারণা, শিক্ষকতা একটি সহজ পেশা। আসলে এটি সবচেয়ে কঠিন। একজন শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে কী পড়াবে তার প্রস্তুতি নিতে হয়, ছাত্রদের সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়, গবেষণা করতে হয়, লেখালেখি করতে হয়।

শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি ব্রত। বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষকের মধ্যে এ চিন্তাটা নেই। সকালবেলা যাব, বিকালে ফিরব, মাস শেষে বেতন নেব- এর নাম শিক্ষকতা নয়। এর বাইরেও শিক্ষকদের অনেক কিছু করতে হয়। যার জন্য চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন থাকবে না।

অনেক শিক্ষকের মধ্যে এ প্রবণতা আছে, তারা ভাবেন এটি করে আমার কী লাভ? আমি কেন করব? শিক্ষকতা করতে গিয়ে সবসময় অর্থের চিন্তা করলে এ পেশায় না আসাই ভালো। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদের চাহিদাও বাড়ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষকদেরও এসব বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মনোভাব হচ্ছে, আমি টাকা দিচ্ছি, শিক্ষকরা ডিগ্রি দেবেন, বেশি মার্ক দেবেন, এমনকি খাতায় না লিখলেও নম্বর দেবেন! এটা মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধ কমছে। এর অন্যতম কারণ স্কুল থেকে তারা শিখে আসছে না।

পাঁচ বছর বয়সে যখন শিশু স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, তখন তার শেখার বয়স। কোমলমতি শিশুদের উর্বর মস্তিষ্কে মূল্যবোধের শিক্ষাটা দিতে হবে। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। কিছু শিক্ষক আছেন, যারা বলেন, আমার কাছে প্রাইভেট না পড়লে নম্বর পাবে না।

এই যে একটা ঋণাত্মক মনোভাব নিয়ে তারা গড়ে উঠছে, সেটার প্রভাব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে এসে মাইন্ডসেট চেঞ্জ করা দুষ্কর। স্কুল শিক্ষকদের কথা আমার এখনও মনে আছে। তারা আমাদের শুধু পড়াতেন না, শেখাতেনও। আর এখন শুধু পড়ানো হয়, শেখানো হয় না।

আমরা কি শুধু চাকরির জন্য শিক্ষা গ্রহণ করি? শিক্ষা গ্রহণ করি মানুষ হওয়ার জন্য। মন-মানসিকতা উন্নত করার জন্য। এ বিষয়গুলো স্কুল থেকে সঠিকভাবে শেখানো গেলে সমস্যা তৈরি হতো না। বইয়ে দেয়া ‘অ তে অজগর, অজগর ঐ আসছে তেড়ে’- এতে শেখার কিছু নেই। শেখাতে হবে ‘অ তে অসৎ, অসৎ ব্যক্তি দেশের শত্র“’। আমাদের স্কুলবেলায় অঙ্কে সুদকষা, ভেজালের অঙ্ক, বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা এসব বিষয় শেখানো হয়েছে। এগুলোর তো কোনো মানে নেই।

শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে যে অবনতির সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। একজন শিক্ষক তার মূল্যবোধকে ভুলে গিয়ে, নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ছাত্রদের শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করছেন।

যাকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়, তিনি তার নীতি ভুলে ছাত্রদের পাস করার শর্টকার্ট উপায় বলে দিচ্ছেন। শিক্ষক-ছাত্রের লেনদেনের সম্পর্কের কারণে ঘটছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো বড় অপরাধ। এর পেছনে অবশ্য শিক্ষকদের আর্থিক অসচ্ছলতাও খানিকটা দায়ী। শিক্ষকতাকে শুধু মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না, বরং তা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন।

বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক খুবই নাজুক। এ সম্পর্কোন্নয়নে উভয়েরই কিছু করণীয় আছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে পরস্পরের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পালন করতে হবে। পরস্পরের কাছে যেসব প্রত্যাশা রয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে হবে।

একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা শিক্ষক তাকে জীবনোপযোগী, যুগোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাকে জ্ঞান অর্জনের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী করবেন। শিক্ষক ছাত্রের ভেতর জ্ঞান লাভের, অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে চেনার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে দেবেন, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবেন। উৎসাহ, প্রেরণা, শক্তি জোগাবেন।

ভালো-মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখাবেন। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন। ছাত্রের কাছেও প্রত্যাশা থেকে যায়। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হল শিক্ষার্থীরা তার দেয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হবে। তার দেখানো পথে চলবে। তাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে, শিক্ষক হিসেবে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে।

শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। তাই শিক্ষকের উচিত, নিজের গুণাবলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। এমন কিছু করা উচিত নয়, যেটি নেতিবাচক। একজন আদর্শ শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবন আমূল বদলে দিতে পারেন। তাকে নবজন্ম দিতে পারেন। স্নেহ-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানে যে সম্পর্ক রচিত হয়, সেই সম্পর্ক যেন সর্বদাই অটুট থাকে।

 

লেখক : উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037951469421387