কুড়িগ্রামের উলিপুরের শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুয়ান সতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৮৩ শিক্ষার্থীর পাঠদানে বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। বন্যার পানিতে ভাঙনের কবলে পড়ে ৬ আগস্ট তিস্তায় বিলীন হয়ে যায় বিদ্যালয়টির ভবন ও ভূমি। যদিও চরাঞ্চল জুয়ান সতরা শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল এ বিদ্যালয়।
দেশের প্রায় চার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুয়ান সতরা বিদ্যালয়টি ছাড়াও আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে গত মার্চ থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও অবকাঠামো হারিয়ে যাওয়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফেরা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। শনিবার (২৯ আগস্ট) বণিক বার্তা প্রত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলোর মাধ্যমে সারা দেশের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের তালিকা করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। তাদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডিপিইর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশের ৩ হাজার ৯১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নদীগর্ভেই বিলীন হয়েছে ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া ৩ হাজার ৮৬৬টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢাকা অঞ্চলে। ঢাকা বিভাগের সর্বমোট ১ হাজার ৪৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে নয়টি বিদ্যালয়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় এর পরের অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। এ বিভাগের ৭৬১টি বিদ্যালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে ১৫টি। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা রংপুরে ৬৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে ১৬টি নদীতে হারিয়ে গেছে। এর বাইরে সিলেট বিভাগে ৫৮২টি, ময়মনসিংহে ৩৮৮টি, চট্টগ্রামে ৫২টি, বরিশালে পাঁচটি ও খুলনায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিলীন হওয়া বিদ্যালয় পুনঃস্থাপন বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীগর্ভে বিলীন ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্থায়ী গৃহনির্মাণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হবে। অন্য বিদ্যালয়গুলোতেও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে মেরামত সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, প্রতি বছরই বন্যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বছরও বেশকিছু বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যার পানিতে। নদীভাঙনের কবলেও পড়েছে কয়েকটি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো। এ বিদ্যালয়গুলোর সংস্কার ও মেরামতের জন্য প্রথমে আমরা মাঠপর্যায় থেকে তালিকা সংগ্রহ করেছি। সে আলোকে এরই মধ্যে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এখনো অনেক এলাকায় বন্যা চলমান রয়েছে। তাই বন্যা শেষে আরেকটি চূড়ান্ত তালিকা করে সে আলোকে বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের কাজ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তালিকা এখনো চূড়ান্ত না হলেও গত সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি খসড়া তালিকা উপস্থাপন করা হয়। ওই তালিকা অনুযায়ী, এবারের বন্যায় সারা দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ৮৭৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খসড়া তালিকা অনুযায়ী, বন্যায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ অঞ্চলে। অঞ্চলটিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯৬টি। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাজশাহীতে ১৮৬টি ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকায় ১৭৬টি প্রতিষ্ঠান এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এর বাইরে রংপুরে ১৪৫, সিলেটে ৫৭ ও কুমিল্লা অঞ্চলে ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন মাউশির উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. রুহুল মমিন। তিনি বলেন, আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর তথ্যের সামষ্টিক হিসাবে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত মাউশির অধীন পরিচালিত ৮৭৩টি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত। মাউশির পাশাপাশি শিক্ষা প্রকৌশল থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়। বন্যা পরিস্থিতি শেষে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও মেরামত করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের বড় একটি ঝরে পড়ার আশঙ্কা শিক্ষকদের। এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রামের উলিপুরের জুয়ান সতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবিএম মিনহাজুল আলম বলেন, এবারের ভাঙনের আগে ২০১৫ সালের ভাঙনের কবলে পড়ে আমাদের বিদ্যালয় ভবন। তখন বিদ্যালয় পুনঃস্থাপনে সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে বিদ্যালয়ের ভবন পুনরায় নির্মাণ করা হয়। যদিও ওই সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কমে যায়। এবার খুব শিগগিরই জেগে ওঠা চরে পুনরায় বিদ্যালয় স্থাপন করা গেলে শিক্ষার্থী সংখ্যা অন্তত তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।