বাংলা চর্চার সংকল্প চাই

যতীন সরকার |

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালির ভাষার দাবির আন্দোলন ছিল না- ছিল অস্তিত্বের দাবিরও সংগ্রাম। ফলে ‘বাহান্ন’ থেকে ‘একাত্তর’- অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের এ স্বাধীন দেশটিকে পেয়েছি।

তাই এ কথা স্পষ্ট যে, একুশে ফেব্রুয়ারি মোটেই শুধু বাঙালির আবেগের প্রকাশ নয়, দৃঢ় এক সংকল্পের প্রকাশ। ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে যে শাসকরা ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিল।

তারা ব্রিটিশদের দেয়া সাম্প্রদায়িকতার চেতনাকেই রাষ্ট্র শাসনের হাতিয়ার রূপে ব্যবহারে উদ্যোগী হল। তাদের সেই সাম্প্রদায়িকতা অনুশীলনের প্রথম শিকার হল বাঙালির ভাষা-বাংলা।

পূর্ব পাকিস্তানে তারা একটি জাতির ভাষাকে কেড়ে নিতে চাইল যে ভাষা চাপিয়ে দিয়ে যেটি কোনো জাতির ভাষা নয়, সৈন্য ব্যারাকের ভাষা উর্দু। ভাষা নিয়ে শাসক শ্রেণীর এ অবিমৃষ্যকারিতার কারণ আর কিছুই নয়, তারা মূলত মানুষের অধিকারের আওয়াজকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। মানুষকে সবচেয়ে সহজে শোষণ করা যায় ধর্মের নামে।

উপমহাদেশের শাসক শ্রেণী সে কারণেই ধর্মের অপব্যবহারের সূচনা করে। কিন্তু তাদের সেই ফাঁকিবাজি বুঝতে খুব দেরি হয়নি এ দেশের মানুষের। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের আত্মবলিদানের পাশাপাশি শরিক হয়েছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আবার ঠিক তেমনই এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল জনযুদ্ধ। নিরস্ত্র কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ অকুতোভয়ে লড়াই করেছে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে।

তাই এটা পরিষ্কার যে একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল বাঙালি জাতির আবেগের বিষয় নয়, বিষয় দৃঢ়তর সংকল্পেরও। কিন্তু সেই একুশে ফেব্রুয়ারিই স্বাধীন দেশের যেন শুধু আবেগের ভাবালুতায় হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে। আমরা স্বাধীন দেশে একুশের সেই প্রতিজ্ঞাকে হারিয়ে যেতে দেখছি।

বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বাংলা ভাষার জন্য যে আবেগ উচ্চারণ করি সেই তুলনায় বাস্তবে আমরা বাংলা ভাষার জন্য ঠিক তেমন কিছু করি না। আমার সুদীর্ঘ ৪২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় এবং এরপরও আজ পর্যন্ত আমি শিক্ষকতার সূত্রেই ছাত্রছাত্রী-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছি। কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আমি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ক্লাস নিয়েছি।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে এ, আমি দেখেছি যে, ছাত্রছাত্রী তো বটেই অনেক শিক্ষকেরও বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণ এমনকি বাংলা অক্ষরগুলোর সঙ্গে সঠিক পরিচয় নেই। এখন যে শিক্ষকের সঙ্গে এগুলোর পরিচয় থাকবে না তিনি কি করে তার ছাত্রছাত্রীদের এগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেবেন? আমি দেখেছি যে, বাংলা ভাষায় প্রচলিত যে সংযুক্ত অক্ষরগুলো রয়েছে, সে সংযুক্ত অক্ষরগুলো অনেক শিক্ষকই সঠিকভাবে চেনেন না।

বাংলা ব্যাকরণের যে সাধারণ রীতি-নীতিগুলো আছে সেগুলো যদি তারা না জানেন তাহলে ছাত্ররা তাদের কাছে কী শিক্ষা পাবে? এ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হচ্ছে- এ ব্যাপারটিতে আমরা একটুও নজর দেইনি। ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষা বিষয়ে সবাই নানা কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা করি কিন্তু বাংলা অক্ষরগুলোই যদি আমরা সঠিকভাবে চিনতে না পারি তাহলে অন্য ভুলগুলো কীভাবে শনাক্ত করব?

বলা যায় বাংলা বানান সম্পর্কে, বাংলা বানান নিয়ে একটা সার্বিক নৈরাজ্য আছে, সেই নৈরাজ্য দূর করার জন্য যে একটা সার্বিক প্রয়াস- সেটা নেয়া হয় না। সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় যেগুলো আছে সেগুলোর বানান সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী হবে- এর কোনো রকম অন্যথা করার সুযোগ নেই কিন্তু সেখানেও দেখেছি নানা রকমের নৈরাজ্য আছে।

কিছু কিছু বানান রীতি বাংলা একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ঠিক করে নিয়েছে কিন্তু সেগুলো সর্বাংশে মেনে নেয়া যায় না। যেমন ‘শ্রেণী’ শব্দটি। যদিও আমি বাংলা একাডেমির নিয়ম মেনে এটি হ্রস্ব-ইকার দিয়ে অর্থাৎ ‘শ্রেণি’ লিখি।

কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী এটি দীর্ঘ-ঈ-কার দিয়ে লেখাই উচিত ‘শ্রেণী’। আমরা সব বানানে হ্রস্ব-ই-কার ব্যবহার করতে দিয়ে ‘অযৌক্তিক’ ‘স্বেচ্ছাচারিতা’র পরিচয় দিচ্ছি। এ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে যৌক্তিক নীতিমালাটি প্রণীত হয়েছিল সেটিও আমরা মানছি না। যৌক্তিকতার ধারাবাহিকতা লঙ্ঘনে আমরা বিপত্তি এবং বিভ্রান্তি তৈরি করছি।

এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আরবি এবং ফারসি শব্দগুলোর ক্ষেত্রে। সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যা ইচ্ছা তাই অবস্থায় আছি- কোনো নিয়মই অনুসরণ করছি না। ‘ইসলাম’ শব্দটি কেউ দন্ত্য-স দিয়ে কেউ ‘ছ’ দিয়ে লিখছে।

‘সালাত’ কেউ ‘স’ দিয়ে কেউ ‘ছ’ দিয়ে লিখছে। অথচ এগুলো ‘আরবি’ এবং ‘ফারসি’ ভাষার ব্যাকরণ অনুসরণে যথাযথ উচ্চারণে প্রমিতকরণ জরুরি। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভূমিকা রাখতে পারে।

আমার মনে হয়, ‘একুশের চেতনা’ বিষয়ে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা যে গাদা গাদা কথা বলি তার চেয়ে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির কাজগুলো আমাদের এখনই শুরু করা কর্তব্য।

শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে নয়, আমরা যেন সারা বছর, সারা জীবন বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে এর চর্চা করি- তাহলেই সম্ভব একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের সামান্য প্রতিদান দেয়া। বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের অবশ্যকর্তব্য।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

সূত্র: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038740634918213