মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদবাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সেই আলাউদ্দিনকে নিয়ে যা লিখেছে দৈনিক প্রথম আলো

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব শেখ আলাউদ্দিন। ধরা পড়ে যান। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি আর সরকারি চাকরিতে নেই। কিন্তু এবার কলূষিত করছেন শিক্ষাখাতকে। ফৌজদারি অপরাধ করা সেই আলাউদ্দিন এখন বেসরকারি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। গতকাল তাকে নিয়ে দৈনিকশিক্ষায় প্রতিবেদন প্রকাশ হলে অমিত মালাংগি নামে এক ব্যক্তি নিজেকে সদ্য প্রকাশিত একটি অপরিচিত জাতীয় দৈনিকের বর্তমান সাংবাদিক ও চ্যানেল আইয়ের সাবেক সাংবাদিক দাবি করে দৈনিক শিক্ষায় ফোন করে মামলা করার হুমকি দেন। অমিত দাবি করেন শেখ আলাউদ্দিন তার শিক্ষক। আর আলাউদ্দিন নির্দোষ। আজ ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোতে ‘সনদ বাতিল হলেও শাস্তি হয়নি কারও’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রোজিনা ইসলাম। প্রতিবেদনে আলাউদ্দিনকে নিয়ে কি লিখেছে তা পড়ুন: 

“ভুল ব্যাখ্যা ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাময়িক সনদ নিয়েছিলেন সাবেক উপসচিব শেখ আলাউদ্দিন। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তিনি পেনশনের টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে শেখ আলাউদ্দিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অসত্য তথ্য দিয়ে দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা নিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান শেখ হিমায়েত হোসেন। চাকরির বয়স ৫৯ হওয়ায় তাঁকে সরকারি কর্মচারী (অবসর) আইন অনুযায়ী গত ৩ মে থেকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি সম্মানী ভাতার টাকা ফেরত দেননি।

শেখ আলাউদ্দিন

একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকারের ছয় সচিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তাঁদের স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল। তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা দেননি, এমন অভিযোগও পাওয়া গিয়েছিল প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাঁদের শেষ পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে চাকরিতে যোগদানের সময়ই তাঁকে তা জানাতে হবে। পরে বললে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিল হয়েছে। এ সময় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে উপসচিবেরও গেজেট বাতিল হয়। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু ২০১৯ সালেই গেজেট বাতিল হয়েছে ২৫৬ জনের। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তদন্ত, জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মতো উপযুক্ত বয়স না হওয়ায় এসব অমুক্তিযোদ্ধার সনদ ও এ-সংক্রান্ত গেজেট বাতিল করা হয়। এখনো জামুকার প্রায় প্রতি বৈঠকেই ৩০-৪০ জনের গেজেট বাতিল হচ্ছে। তাঁরা ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করে যথারীতি এ সুবিধা নিয়েছেন। পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি দপ্তর ও এলাকাবাসীর সাক্ষ্যপ্রমাণে বেরিয়ে আসে যে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন।

 মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সনদ নিয়েছেন, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অবসরে গেছেন, এমন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, যেসব সরকারি কর্মকর্তা ভুয়া সনদ নিয়েছিলেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে অবশ্যই ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। তাঁরা সুবিধা নিয়েছেন কি না, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাঁরা যে অসত্য তথ্য দিয়ে সনদ নিয়েছেন, এটাই বড় অপরাধ। সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও অবসর–সুবিধা দেওয়া উচিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কাছে সনদ বাতিল হওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা চাইব। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবই।’

সরকারের ছয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। আর সাবেক সচিব এবং বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানেরও সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়। দুদকের তদন্তে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দুই বছরে কোনো মামলা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী আখতার হোসেন। তাঁর কাছে মুক্তিযোদ্ধা–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র চাইলে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তা দেননি। পরে তিনি এ সুবিধা আর পাননি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, শুধু যাঁরা ভুয়া সনদ নিয়েছেন তাঁদের নয়, যাঁরা এসব সনদের জন্য সুপারিশ করেছেন, সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদধারী সেই উপসচিবই বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক!

ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তা অপরাধ। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য তিন বছর জেল এবং মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হওয়ার কথা।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নেওয়ায় কর্মকর্তাদের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী, অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সনদ বাতিল কোনো শাস্তি নয়। আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নেওয়া তো আরও বড় অপরাধ। যাঁরা জালিয়াতি করে সনদ নিয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভাতা নিয়েছেন, সুবিধা নিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার সুপারিশ করেছেন, যে কর্মকর্তা গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

 মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে যাঁরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নিয়েছেন, তাঁদের সনদ মন্ত্রণালয় বাতিল করেছে। মন্ত্রণালয় থেকে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বলা হয়েছিল। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা কোনো পদক্ষেপ এত দিনেও নেয়নি। আসলে ব্যবস্থা নিতে গেলে কেউ তো আর বাকি থাকবে না, তাই হয়তো এ বিষয়ে আর এগোয়নি।’

এদিকে ছয় বছর হতে চললেও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া সোনার ক্রেস্টে জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কারও শাস্তি হয়নি। এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত প্রথম তদন্ত কমিটি সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ১৩ কর্মকর্তা ও দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছিল। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি। এত বড় জালিয়াতির ঘটনায় ছয় বছরেও বিচার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিশিষ্টজনেরা। জালিয়াতির এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি করেছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ঘটনার তদন্তে অনুসন্ধান কমিটি করেছিল। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছিল, শেষ পর্যন্ত তাঁদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। শাহবাগ থানায় মামলা করেছি। কিন্তু আমাদের কাছে কেউ কিছু জানতে চায়নি।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063250064849854