১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনটির কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আসার কথা। অনার্স পরীক্ষায় যারা ফার্স্ট এবং সেকেন্ড হয়েছে তারা বঙ্গবন্ধুর সেই অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়েছে। সেই হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত। আমি যথেষ্ট উত্তেজিত এবং ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অনুষ্ঠানে যাবার জন্য শার্ট ইস্ত্রি করছি তখন পাশের বাসা থেকে আমাদের প্রতিবেশী আর্তনাদ করে উঠে আমাদের জানালেন— গতরাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলেছে। তখন সেটি বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা ছিল না। আমরা তাই দৌড়ে পাশের বাসায় গিয়েছি। আমাদের বাসায় রেডিও-টেলিভিশন নেই, খবরের জন্য প্রতিবেশীর উপর নির্ভর করতে হয়। তাদের বাসায় গিয়ে রেডিওতে শুনতে পেলাম, একজন মানুষ নিজেকে মেজর ডালিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরটি বেশ নির্বিকারভাবে পরিবেশন করছে।
খবরটি তখনও অবিশ্বাস্য ছিল। এতোদিন পরেও সেটি অবিশ্বাস্য। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না, আমরা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। আমার বয়স তখন কম, অভিজ্ঞতা আরো কম। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুধুমাত্র জেনেছি, এই হত্যাকাণ্ডের ফলাফল কী হবে অনুমান করার ক্ষমতা ছিল না। তিন মাসের মাথায় যখন জেলখানায় আওয়ামী লীগের আরও চারজন নেতাকে হত্যা করা হলো তখন হঠাত্ করে আমরা বুঝতে শুরু করেছি দেশটিতে ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সেই ভয়াবহ ঘটনার ধাক্কা আমাদের পরিবারও বুঝতে শুরু করেছে। আমার বোনের বিয়ে হয়েছে একজন রাজনৈতিক নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা, অ্যাডভোকেট আলী হায়দার খানের সাথে, তাকে অ্যারেস্ট করে বরিশাল জেলে রাখা হয়েছে। বোনের ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে হয়েছে, সেই অবস্থায় সারারাত লঞ্চে করে বোনকে নিয়ে জেলখানায় আটক তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাই। কতো আশা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তিন বছরের মধ্যে সেই স্বাধীন দেশের সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেছে।
এরপর কতো বছর পার হয়ে গেছে। এখনও আমরা সেই ৪৩ বছর আগের পঁচাত্তরের দিকে ফিরে ফিরে তাকাই। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে কারা হত্যা করেছে সেটি জানতে চাইলে আমাদের বলা হয়— তারা ছিল কিছু উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক। মনে হয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক বুঝি বেপরোয়া হয়ে ঝোঁকের মাথায় এই সর্বনাশা কাজটি করেছে। আমার একজন তরুণ সহকর্মী মনে করে বিষয়টি আরো অনেক গভীর। সেটি আসলে মূলত আন্তর্জাতিক একটি ষড়যন্ত্র। প্রমাণ হিসেবে সেই সময়কার অনেকগুলো সরকার পরিবর্তন এবং হত্যাকা্লের কথা সে মনে করিয়ে দেয়।
কঙ্গোর স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্যাট্রিস লুমুম্বা। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের ভেতর সিআইএ এবং বেলজিয়ামের শাসকেরা মিলে তাকে হত্যা করেছে। চিলির সালভাদর আলেন্দে ছিলেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিন বছরের মাথায় সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে চিলির সেনাবাহিনীর জেনারেল পিনোশে তাকে হত্যা করে। তিনি নিজে যুদ্ধ করতে করতে মারা যান। ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশের অর্থনীতির সংস্কারে হাত দেয়া মাত্র সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে সেই দেশের সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেশছাড়া করে। ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতায় গিয়ে যখন তাদের তেলক্ষেত্র জাতীয়করণ করে নিজ দেশের উন্নতি করার জন্য নিজ দেশের সম্পদ ব্যবহার করতে শুরু করেন সাথে সাথে তাকে সরিয়ে দিয়ে জেলখানায় নিক্ষেপ করে সিআইএ এবং ব্রিটেন। গুয়াতেমালার জ্যাকাবো আরবেঞ্জ যখন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়ে মার্কিন কোম্পানির হাত থেকে নিজ দেশের ভূমিকে মুক্ত করার কাজ শুরু করেছেন আবার, তখন সেই দেশের সেনাবাহিনী সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে তাকে দেশ-ছাড়া করেছে। এক দেশ থেকে অন্যদেশে শরণার্থীর মতো ঘুরতে ঘুরতে একসময় মারা গেছেন। কোয়ামে নক্রুমা ঘানার স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিজ দেশে যখন সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছেন সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে সেই দেশের সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
এই সময়কালে শত ষড়যন্ত্র করেও সিআইএ কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা করতে পারেনি। ফিদেল ক্যাস্ত্রো ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আপনজন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন— ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখছি’। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করার পর দেশটি কেমন করে পরিচালনা করতে হয় সে ব্যাপারে তিনি বঙ্গবন্ধুকে উপদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির সালভাদর আলেন্দে, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, গুয়াতেমালার জ্যাকাবো আরবেঞ্জ কিংবা ঘানার কোয়ামে নক্রুমার মতোই বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সপরিবারে হত্যা করেছে এই দেশের সেনাবাহিনীর একটা অংশ।
পৃথিবীর এই ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি বিষয়ে মিল ছিল। তিনিও তাদের মতো জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। আমাদের প্রথম সংবিধানে স্পষ্ট করে দেশ শাসনের মূলমন্ত্র হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লেখা ছিল। তিনিও অন্য সবার মতো নিজ দেশের সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বাপেক্সকে শক্তিশালী করেছেন বলে এখন আমরা আমাদের তেল-গ্যাস কোম্পানির মালিক।
তবে একটি বিষয়ে পৃথিবীর অন্যান্য ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। তাকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে যে অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছিল সেরকম আর কাউকে করা হয়নি। আমরা এই ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি, কাজেই তথ্যটি আমরা বহুকাল থেকে জানি। কিন্তু যারা প্রথমবার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারে তাদের পক্ষে সেটি গ্রহণ করা দূরে থাকুক, বিশ্বাস করাও কঠিন। সেই হত্যাকাণ্ডে নারী-পুরুষ-শিশু ছিল, সদ্য বিবাহিত তরুণ-তরুণী ছিল, অন্তঃসত্ত্বা নারী ছিল এবং একটি দেশের স্থপতি সেই দেশের জাতির পিতা ছিল। এটি কি বিশ্বাস করার মতো কোনো ঘটনা? কোনো মানুষের পক্ষে কি এরকম নৃশংস হওয়া সম্ভব? না কী আমাদের বলতে হবে শুধুমাত্র মানুষের পক্ষেই এরকম নৃশংস হওয়া সম্ভব। বনের পশু তো কখনো কাউকে এতো নৃশংসতায় হত্যা করে না।
এরপরের ঘটনা কী আরো বেশি অবিশ্বাস্য নয়? যে মানুষগুলো বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে তাদেরকে যেন বিচার করা না যায় সেজন্য সংসদে ইনডেমনিটি বিল পাস করে সেটি সংবিধানে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। সভ্যতার ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের কেশ স্পর্শ করা যাবে না সেটি সংবিধান দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে এরকম ঘটনা কী পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব? শুধু কী তাই, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বঙ্গবন্ধুর নামটি বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া শুরু হলো। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করে বুঝতে পারি না, কোনিট বড় অপরাধ, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করা না কি হত্যাকারীদের নিরাপত্তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নামটি এই দেশের মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া?
দেশের এই অন্ধকার সময়ে আমি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে। একবার দেশে এসেছি, রিকশা করে এক জায়গায় গিয়ে রিকশাওয়ালাকে রিকশাভাড়া হিসেবে দশ টাকার একটি নোট দিয়েছি। ছিয়াত্তরে দেশের বাইরে যাবার সময় এই নোটটি পকেটে ছিল। রিকশাওয়ালা নোটটি নিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল: আমাকে এটি কি নোট দিয়েছেন? এই নোট এখানে চলে না। নোটের উপর এটি কার ছবি? নোটের উপর বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম এই দেশে এখন এমন মানুষ আছে যারা বঙ্গবন্ধুকে চিনে না। যে মানুষটি এই দেশটির স্থপতি, এই দেশের মানুষ তাকে চিনবে না এটি কেমন করে হয়?
আমি চুরানব্বই সালে দেশে ফিরে এসেছি। এসে অবাক হয়ে দেখছি এই দেশের রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয় না। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দেখা হলে মাঝে মাঝেই তারা জিজ্ঞাস করে— “স্বাধীনতার ঘোষক কে? জিয়াউর রহমান না কী শেখ মুজিবুর রহমান?” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি, এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যারা বাংলাদেশের ইতিহাস জানে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে না। তারা বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা জানে না। তাদের ধারণা— একজন মানুষ একটা ঘোষণা দিলেই একটা দেশের জন্ম হয়ে যায়।
তারপর ছিয়ানব্বই সালে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমি তখন আমার স্ত্রীকে বলেছি— চল, আমরা একটা টেলিভিশন কিনে আনি। এখন নিশ্চয়ই টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখাবে।
আমি আর আমার স্ত্রী পরিচিত এক বন্ধুকে নিয়ে বাজার থেকে টেলিভিশন কিনে এনেছি। সেই টেলিভিশনে বহুকাল পরে প্রথমবার বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমাদের চোখ ভিজে এসেছিল।
খুব ধীরে ধীরে এই দেশের নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা শেখানো হয়েছে। আমি লক্ষ্য করি, পথেঘাটে আজকাল কোনো শিশু বা কোনো কিশোর-কিশোরী আমার কাছে জানতে চায় না, স্বাধীনতার ঘোষক কে?
সংবিধান থেকে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি বিল’ সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা হয়েছে। এতোদিন যারা এদেশে সদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। দেশের বাইরে যারা রয়ে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের ভেতরে আর বীরত্বের অহংকার নেই। তারা এখন পালিয়ে থাকা খুনি, লুকিয়ে থাকা খুনি, আকণ্ঠ ঘৃণায় ডুবে থাকা খুনি।
কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজে পাইনি। যারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তারা কী বড় অপরাধী না কী যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষা করে এদেশের মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে তারা বড় অপরাধী? কে উত্তর দেবে?
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। তাই যারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে তারা বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে। এই দেশের মাটিতে থেকে এই দেশকে যারা অস্বীকার করে, বাংলাদেশে তাদের কোনো স্থান নেই। আমি বিশ্বাস করি, এই দেশের মাটিতে থেকে রাজনীতি করার প্রথম শর্ত হচ্ছে, তাকে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধকে বুকের ভেতর ধারণ করতে হবে।
এর বাইরে থেকে যতদিন কেউ রাজনীতি করার চেষ্টা করবে বাংলাদেশ ততদিন গ্লানিমুক্ত হতে পারবে না। আমি বহুদিন থেকে সেই গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশের জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
লেখক :কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।