নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরী উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নবাব।তার জন্ম ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমগাঁও, লাকসাম,কুমিল্লায়। পিতা ছিলেন জমিদার আলী আহমদ চৌধুরী,মাতা আফরান্নেছা চৌধুরী। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জমিদারির দায়িত্ব পান।জমিদারির অনেক সুনাম তার রাজ্যময় ছড়িয়ে পরেছিল। প্রজাবৎসল অনেক কাজে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন।তার দান-দাক্ষিণ্য চারদিকে সমাদৃত।
মুসলিম নারী হওয়ায় তিনি কঠোর পর্দা প্রথা মেনে চলতেন,তবে তার মধ্যে কোন কূপমণ্ডূকতা ছিলনা। চিন্তা চেতনায় বরাবর আধুনিক ছিলেন। তার বাসায় তিনি উর্দু,ফার্সিতে কথা বলতেন। তবে তিনি ভালো বাংলা জানতেন। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন তা হলো তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ফার্সি, উর্দু চর্চার ব্যাপক প্রচলন ছিল। যা হোক তিনি প্রজাবৎসল হওয়ার কারণে,প্রজাদের সাথে বাংলায় কথা বলতেন। শুধুতাই নয় তার অমোঘ সৃষ্টি কাব্যগ্রন্থ " রুপজালাল "সেটি বাংলায় রচনা করেন। এই রচনার মধ্য দিয়ে তার কবি প্রতিভার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
উনবিংশ শতাব্দীতে যেখানে নারী শিক্ষার কল্পনাই করা যায়নি,ঠিক সে মুহুর্তে তিনি প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নারীদের জন্য আলোর মশাল নিয়ে আবির্ভূত হন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলমানদের অধঃপতন শুরু হয়। একদিকে ব্রিটিশদের বৈরি আচরণ,অন্যদিকে নিজেদের গোঁড়ামি,পশ্চাৎমুখী মনোবৃত্তি,অশিক্ষা-কুশিক্ষা,আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা প্রভৃতি কারণে মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল। ইংরেজি ভাষাকে ভাবা হতো ভিন্ন পরধর্মীয় ভাষা। স্বয়ং মীর মোশাররফের মতো প্রগতিবাদী সাহিত্যিক ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে বলেন,'ইংরেজি ভাষা শয়তানের ভাষা, এই ভাষা শিখলে ঘুডুমুডু হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হবে"। ঠিক সেই সময় ফয়জুন্নেছা ১৮৭৩ কুমিল্লা শহরে নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
উল্লেখ্য যে, ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফয়জুন্নেছার স্থাপিত ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পূর্বে সমগ্র বঙ্গদেশে মুসলিম মেয়েদের জন্য কোনো স্বতন্ত্র বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কুমিল্লায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের দু- বছর ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড়ে স্থাপিত হয় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ। এটি পরে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়। আর কুমিল্লায় ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের ৩৮ বছর পর ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বেগম রোকেয়া কলকাতায় স্থাপন করেন "সাখাওয়াত মেমোরিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয় "।এই বিদ্যালয়টি ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কয়েকজন মুসলিম মনীষী বাংলার মুসলমান সমাজকে শিক্ষায় আলোর পথ দেখানোর জন্যে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে নওয়াব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,ঠিক ওই সময় মুসলমান নারী -পুরুষের কল্যাণে শিক্ষার মশাল নিয়ে এগিয়ে আসেন নবাব ফয়জুন্নেছা। মোদ্দাকথা,বাংলার নারী -পুরুষের শিক্ষার দ্বারোদঘাটনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন একমাত্র নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরী।
তিনি তার জমিদারির ১৪ টি মৌজায় ১৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরী ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি শৈলরানী দেবি হাই স্কুলের প্রাথমিক বিভাগ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ফয়জুন্নেছা যখন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তখন কুমিল্লা শহরের ইনকামটেক্স উকিল মি. লাল মোহন ভট্টাচার্য তার পত্নির স্মৃতি রক্ষার্থে ফয়জুনকে অনুরোধ করলে সেই থেকে ওই স্কুল শৈলরানী দেবি হাই স্কুল হয়।
মৃত্যুর কিছু পূর্বে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে বদরুন্নেছা -ফয়জুন্নেছা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়টি তার বাসভবনের অল্প দূরে স্থাপন করে গেছেন। ঐ স্কুল লাগোয়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। তার সুফল এলাকার জনগণ আজো পাচ্ছে।
দূরদর্শী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরী একাধারে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা,আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে সবিশেষ অবদানের সাক্ষর রেখেছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য তিনি পশ্চিমাগাঁও নিজ বাসভবনের পাশেই শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মক্তবের ব্যবস্থা করেছিলেন। এটি কালের আবর্তে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং পরবর্তীতে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা শহরে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কলেজটি ভিক্টোরিয়া কলেজ নামে সমধিক পরিচিত। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায়। তার আহবানে ফয়জুন উক্ত কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে ১০,০০০ টাকা অনুদান করেন। শিক্ষায় নারী -পুরুষ নির্বিশেষে সবার দ্বার উন্মীলন ঘটান। তবে নারী শিক্ষার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে নারী শিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে।
এই মহিয়সী নারীর মৃত্যু বার্ষিকী আজ ২৫ সেপ্টেম্বর। একেবারে নীরবে নিভৃতে সারাজীবন জনস্বার্থে কাজ করে গেছেন। মরণোত্তর ২০০৪ এ তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদকে ভূষিত হন। আশার কথা পশ্চিমগাঁও, লাকসামে তার নিজের বাসভবনটি সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এই ঐতিহ্য রক্ষার্থে এগিয়ে এসছে।
নবাব ফয়জুন্নেসা শিক্ষা বিস্তারে সারাজীবন কাজ করে গেছেন। অদ্য তার মৃত্যুর দিনে তার মাগফেরাত কামনা করছি,সেই সাথে এই প্রত্যাশা করি তার আদর্শিক কর্ম কখনও মুছে যাবে না,যতই দিনযাবে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নতুনভাবে তার উন্মীলন ঘটবে। শুধু এদেশের নারী না,বিশ্বের বুকে নারীদের প্রেরণার উৎস হয়ে আলো ছড়াবে যুগের পর যুগ।
আক্তার খান মুকুল, সহযোগী অধ্যাপক,সমাজবিজ্ঞান, নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ,কুমিল্লা।