বাংলাদেশের সমুদ্র সময়

মোহাম্মদ আরজু |

আসমুদ্রহিমাচল। সমুদ্র থেকে হিমালয় পর্যন্ত এই ছিল আমাদের বাংলাদেশ। বাণিজ্য-বায়ুর জলপথ ধরে ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ী আর সেনারা গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এইটুকুতেই সীমিত করে রেখেছিল ভারতবর্ষের মন ও মনন। কাজ-কর্মেও। চিত্ররূপময় বাংলার কবি জীবনানন্দের কবিতার বাইরে আমাদের জাতীয় মননে সমুদ্রের উপস্থিতির সাক্ষ্য খুবই কম। উপকূলের সমাজে দুর্যোগের দিগন্ত হিসেবে বেশ বদনাম অবশ্য ছিল সমুদ্রের; আর আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জলপথ, এইটুকুই।

অথচ পৃথিবীর অখণ্ড মহাসমুদ্রের থেকেই হিমালয় লাখো বছর আগে মাথা উঁচু করে ছিল। হিমবাহ থেকে বইয়ে দিয়েছিল জলস্রোত আর পলিপ্লাবন, দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে। বঙ্গোপসাগর যার ডাকনাম। সমুদ্র আর ভূখণ্ডজুড়ে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে চলা নদীগুলোই বাংলার প্রাণ। এই আমাদের প্রতিবেশ, আমাদের জীবনের শুভ ও অশুভ। হিমালয়ের পলি-জলস্রোত দীর্ঘ সময় ধরে তুমুল বায়ু আর বঙ্গোপসাগরের ঢেউ ও স্রোত মিলেই পৃথিবীর উর্বরতর ও প্রাণময় এ অঞ্চল তৈরি করেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নদী অববাহিকা এই বঙ্গসমতল, দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ নোনাবালির তীর এখানে, হিমালয়ের পলি-জলে এখানে সাগরতলে তৈরি হয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাগরতলের ফ্যান দি বেঙ্গল ফ্যান।

জলজ জন্মের এই দেশে পানি ও প্রাণের সম্পর্ক মানিক-জোড়ের মতো। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উপকূল-রেখায় এই নদীরা সাগরে মিলেছিল। কিন্তু উজানে এসব নদীর জলপ্রবাহে বাধা দেওয়ার কারণে এরা মরেছে। হাজারের বেশি নদীর দেশে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাতায় ৩১০টি মাত্র বেঁচে আছে। নদীগুলোর এই মৃত্যুর ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের সাগরজলেও লেখা আছে, উপকূলবর্তী এলাকায় নোনা বাড়ছে, উজানের থেকে স্বাদুজলের প্রবাহ কম থাকায় উপকূলের অনেক ভেতরের জলও নোনা হয়ে উঠছে।

এমন এক সময়ে এই নদী-বিপর্যয় ঘটছে যখন দুনিয়াজুড়ে বিপর্যয়ের কাল। জীবাশ্ম জ্বালানির বহু ব্যবহারে যখন পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাচ্ছে দ্রুত, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা যখন বাড়ছে, তখন নদী-বিপর্যয় আরও এক বাড়তি বিপদ তৈরি করছে নিচু ব-দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য। জলবায়ুর দ্রুত বদলে যাওয়া আর সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার খারাপ পরিণতিকে আরও বিষিয়ে তুলছে উজান থেকে স্বাদু জলের অভাব।

তবে একই সঙ্গে আশার দিক হচ্ছে, ঠিক এই সময়েই নানা কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে, মননে, চিন্তায়, কাজে-কর্মে আবার প্রবল হয়ে ফিরছে সমুদ্র। গত চার-পাঁচ বছর ধরে বঙ্গোপসাগর কিংবা সমুদ্র ইত্যাদি শব্দ যতবার উচ্চারিত কিংবা লিখিত হয়েছে বাংলাদেশে, তা গত কয়েক দশকে বে-নজির। এ এক শুভ লক্ষণই, আমি বলব। উপলক্ষ যা-ই হোক, বার্মা ও ভারতের সমুদ্রসীমানার নিষ্পত্তি উপলক্ষে হলেও, অন্তত সমুদ্রের আলোচনা তো ফিরে এসেছে এই দেশে।

স্থলভাগে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের জীবন কেমন হবে, তা নির্ভর করে পৃথিবীর মহাসমুদ্রের ওপর। আমাদের উপকূল ঘেঁষে যাকে আমরা বঙ্গোপসাগর ডাকনামে চিনি, তার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান। দেশে বৃষ্টির পরিমাণ ও ধরন, আবহাওয়া, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে সাগরজলের গুণাগুণের ওপর। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, বন ও পরিবেশের সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য।

অপার শক্তি ও সম্ভাবনার ধারক এই মহাসমুদ্রকে বিজয় করা সম্ভব নয় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের গত দুই দশক শেষে পৃথিবীর মানুষ এখন এটা উপলব্ধি করতে পারছে। যা করণীয়, তা হচ্ছে সমুদ্র-যাপন। সামুদ্রিক প্রতিবেশের ক্ষতি না করে, এই সুনীল-পৃথিবীর ভারসাম্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনশৈলীর চর্চা।

স্থলভাগে আমরা যা-ই করি না কেন, আমাদের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সরাসরি প্রভাব সামুদ্রিক প্রতিবেশের ওপর পড়ে। তেল-গ্যাস-কয়লা যত জীবাশ্ম জ্বালানি আমরা ব্যবহার করি তত বেশি কার্বন জমা হয় সমুদ্রে, তত বেশি উষ্ণ হয় সমুদ্রজল, জল তত এসিডিক হয়। নষ্ট হয় নানা প্রাণের বসতি; সামুদ্রিক প্রাণেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যেমন গত ২০১৪ সাল থেকে দুনিয়াজুড়ে মারা পড়ছে অনন্য সামুদ্রিক প্রাণ- প্রবাল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রবাল-প্রাচীর অস্ট্রেলিয়া উপকূলের গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে মাইলের পর মাইল প্রবাল মারা পড়ছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে একমাত্র প্রবাল-বসতি; সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারপাশে দেখা গেছে প্রচুর প্রবাল মারা পড়েছে। প্রবালের মতো ‘ক্যালসিফাইং’ সামুদ্রিক প্রাণের মৃত্যু হলে বিজ্ঞানীরা যাকে ‘সমুদ্রের ঘ্রাণ’ (ডাই-মিথাইল সালফাইড) বলেন, তা আর যোগ হয় না সমুদ্রজলে। ভালো বৃষ্টির মেঘ আর তৈরি করতে পারে না ওই সমুদ্র-জল। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার যত কম থাকবে, বিশ্বসমুদ্র তত উষ্ণ হবে, বরফ গলবে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে; বাড়বে দুর্যোগ।

জীবশ্ম জ্বালানি শুধু পুড়লেই নয়, সাগরতলে জীবাশ্ম জ্বালানি খুঁজতে গিয়েও নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ ও প্রাণ। এই যেমন সবশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্তও চট্টগ্রামের পশ্চিম সমুদ্রে একটি জরিপ-জাহাজ সাগরতলে খুঁজে বেড়িয়েছে জীবাশ্ম-জ্বালানির ক্ষেত্র। এমন ভূতাত্তি্বক জরিপ চালাতে অনেক অনেক মাত্রা সংকুচিত বাতাস (কমপ্রেশ্ড এয়ার) ছুড়ে দেওয়া হয় সমুদ্রতলের দিকে। যাকে বিজ্ঞানীরা সিসমিক ব্লাস্ট বা এয়ারগান টেস্টিং বলেন। এতে এত উঁচুমাত্রার শব্দ হয় সাগরজলে, যা একটি দূরগামী বিমানের জেট ইঞ্জিনের চেয়ে এক লাখ গুণের চেয়ে বেশি।

তিমি ও ডলফিনের মতো যেসব বিরল প্রাণীর জীবনযাত্রায় শব্দতরঙ্গের ব্যবহারই প্রধান উপায়, তাদের শব্দতরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এতে। সাগরতলের পুরো প্রতিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব প্রমাণিত। সাগরতলের এই বিপর্যয় কারও কাম্য হতে পারে না। জীবাশ্ম জ্বালানিও আর স্বাগত নয় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই দুঃসময়ে। বায়ু, জল আর সূর্যালোকের মতো প্রতিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎসের দিকেই আমাদের ফিরতে হবে।

যে কারণেই হোক, দেশের জাতীয় পরিসরে সমুদ্র যখন আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে, তখন সামুদ্রিক প্রাণ ও প্রতিবেশের ভাগ্যও ফিরে আসুক এ-ই প্রত্যাশা। কারণ সুন্দর ও সুস্থ সাগরই পৃথিবীকে নিরাপদ রাখবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র দিবসের যেই প্রতিপাদ্য এবার; সুস্থ সাগর-সুস্থ পৃথিবী এ-ই হোক আমাদের প্রত্যয়। এই সময় হোক নিরাপদ সমুদ্রের।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003026008605957