প্রতিষ্ঠার ৯৮ বছরবাঙালি মুসলমানের শিক্ষা উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৭৫৭ সালে পলাশীর ময়দানে বাঙালি মুসলমানের ভাগ্যবিপর্যয়ের পর দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে তারা। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলের দুইশ বছর নানা ধরনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাদের। এই সংগ্রাম তাদের ক্রমেই নিঃস্ব করে দেয়। ব্রিটিশ শাসক ও তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা প্রশাসনকে প্রত্যাখান করায় বাঙালি মুসলিমরা পরবাসীর পর্যায়ে নেমে আসে। দিন দিন বাড়তে থাকে তাদের বঞ্চনা। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের মতো শিক্ষার সংকট বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রকট হয়ে দেখা দেয় তখন। বিশেষত উচ্চশিক্ষায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই বাঙালি মুসলমানের ভাগ্যোন্নয়নে একটি আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল অপরিহার্য। মুসলিম বাঙালি নেতাদের দাবি, চেষ্টা ও ত্যাগের বিনিময়ে ২১ জুলাই ১৯২১ ঢাকায় যাত্রা শুরু করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সোমবার (০১ জুলাই) কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন শেখ আবদুল্লাহ বিন মাসউদ।

১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে এই দেশের মুসলিম সমাজে ব্যাপক আশাবাদ সৃষ্টি হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয় বছরে এই অঞ্চলে শিক্ষার বিপুল অগ্রগতি হয়। বাংলাপিডিয়ার বিবরণ অনুযায়ী, ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১০-১১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৫১ থেকে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৩-তে উন্নীত হয় এবং প্রাদেশিক কোষাগার থেকে এই খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ১১ লাখ ৬ হাজার ৫১০ টাকা থেকে ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৩৯ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিরোধিতায় বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এতে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ আশাহত ও ক্ষুব্ধ হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ ও উচ্চশিক্ষায় বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকা সফরে আসেন ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ১৯১২ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারত সচিব অনুমোদন দেন। ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

মাত্র তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি মহীরুহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনিস্টিটিউট, ২০টি আবাসিক হল, তিনটি হোস্টেল, এক হাজার ৯৯২ জন শিক্ষক ও ৩৭ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

মুসলিম সমাজ ও ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। নাথান কমিটির প্রধান তিন সুপারিশের একটি ছিল ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য ছিল এমন : ‘আমরা ভুলে যাইনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম প্রধানত পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের উচ্চশিক্ষায় সুযোগ বৃদ্ধির দাবিতেই হয়েছে।’ সেই হিসেবে প্রতিষ্ঠাকালে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই তার ইসলামসংশ্লিষ্ট অনেক বৈশিষ্ট্য থেকে সরে গেছে; যেমন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে কোরআনের আয়াত ‘ইকরা বিসমি রব্বিকাল্লাজি খালাক’ বাদ দেওয়া, প্রতিষ্ঠাকালে ‘মুসলিম হল’ নাম থাকলেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ ফেলে দেওয়া, বিষয় নির্বাচনে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বৈষম্যের শিকার হওয়া ইত্যাদি। বিষয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন অনেকেই। অবশ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট হওয়ার পর তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সলিমুল্লাহ হলের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি আবার যুক্ত হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষত ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির সব স্বাধিকার আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পৈশাচিক গণহত্যার শিকারও হয়েছেন প্রতিষ্ঠানের খ্যাতিমান অনেক শিক্ষক। স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। এখনো দেশ ও জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043439865112305