বাজেট ও বেসরকারি শিক্ষক সমাজ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এ লেখাটি চলতি মাসের প্রথম দিকে লেখার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু হয়ে ওঠেনি৷ নানা ব্যস্ততার কারণে লেখালেখি নিয়ে বসা হয়নি কিছুদিন৷ মাঝখানে কয়েক সপ্তাহ দেশের বাইরে থাকায় এমনিতে দৈনিক শিক্ষার অগণিত পাঠককে প্রচণ্ড মিস করেছি৷ অবশ্য গত দু'-তিনদিন আগে একটি লেখা পাঠিয়ে কিছুটা হলেও গ্যাপ কমাতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে৷ যাক, এখন আসি মূল কথায়৷

চলতি অর্থ বছরে দেশে একটা বিশাল বাজেট পাস হয়েছে৷ এত বড় বাজেট বাংলাদেশ আর কোনোদিন পায়নি৷ নিশ্চয় এটি 'মেগা বাজেট'৷ বর্তমান অর্থ বছরের এ বাজেট আমাদের সক্ষমতার বিষয়টিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে৷ নির্মিয়মান পদ্মা সেতু, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান ইত্যাদি বিষয় সারা দুনিয়ায় আমাদের আর্থিক সঙ্গতি আরও আগেই জানান দিয়েছে যে, এখন অনেক কিছু আমরা নিজেরাই পারি, অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না-সে প্রমাণটুকু আমরা বিশ্ববাসীকে দিতে পেরেছি৷ এবারের বাজেটও এর একটা বড় উদাহরণ৷

গত ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার যে বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল তা এক রকম কোনো কাটছাঁট না করেই ৩০ জুন পাস হয়৷ এর পরদিন অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কের অভিযাত্রী হয়েছে চলতি অর্থ বছরের বাজেটের আকার দেখে সেটি কারো বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়৷

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবারের মেগা বাজেটেও শিক্ষা কিংবা শিক্ষকদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই৷ আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলার চোখে দেখা যেন একটা অন্য রকম ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সেটি থেকে এবারও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি৷ এর খেসারত জাতিকে দিতে হয়েছে এবং আরও দিতে হবে৷ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ার আশংকা থেকেই যায়৷ একমাত্র শিক্ষাখাতকে অবহেলার কারণে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি৷

শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দিতে ব্যর্থ হবার কারণে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে নারাজ৷ শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনীহা দেশ ও জাতীর জন্য অশনি সংকেত৷ যারা রাষ্ট্র ও সরকার চালান তারা যদি বিষয়টি উপলব্ধি না করেন তবে শিক্ষায় সুদিন আশা করা দুরাশার সমান৷ দেশে ফি বছর বাজেট ঘোষিত হবার পর শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে যে বাগাড়ম্বর করা হয় তা যদি সঠিক হতো তাহলে এতদিনে আমাদের শিক্ষা বিশ্বমানে উন্নীত হয়ে যেত৷

এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তির জন্য ৭৯ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে৷ শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি জুড়ে দিয়ে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ থেকে প্রযুক্তি খাতে কেটে নেবার পর শিক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ কত থাকে সেটা ভেবে দেখার বিষয়৷  জিডিপি'র অনুপাতে আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ২ শতাংশের বেশি হয় না৷ এটি খুবই অপ্রতুল৷

ইউনেস্কো শিক্ষাখাতে জিডিপি'র ৬ শতাংশ বরাদ্দের তাগিদ দিয়ে থাকে৷ তারপরও যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয় তা যদি দুর্নীতির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়ে যায় তাহলে এ জাতি বাঁচে কী করে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে যে দু’-তিনটি খাতে সবচে’ বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে শিক্ষা তার একটি৷ কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সে দেশে সুনীতি বা সুশাসন অনিশ্চিত হয়ে যায়৷

তদুপরি শিক্ষাখাতে বরাদ্দের সিংহভাগ অবকাঠামোগত উন্নয়ন,বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উপবৃত্তি ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়ে যায়৷ তাতে শিক্ষা ও শিক্ষকের উন্নয়নে খুব একটা আলোকপাত করা হয় না বলে  শিক্ষার যেমন বেহাল দশা তেমনি শিক্ষকদের দুর্দিন লেগেই আছে৷

আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা কেবল কাব্যে ও কবিতায়৷ কাগজে কলমে আর মুখে মুখে আমরা শিক্ষকদের উজাড় করে সম্মান দেই৷ ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ কিংবা ‘কেবল সালামে পেট ভরে না’- সে কথাগুলো বেমালুম ভুলে থাকি৷ শিক্ষক সমাজকে সত্যিকারের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাইলে তাদের আর্থিক মর্যাদার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনতে হবে৷

সমাজে দেনার দায়ে জর্জরিত কোনো শিক্ষক যেমন নিজে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে পারেন না, তেমনি তার দ্বারা আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক তৈরি করা সম্ভব হয় না৷ এ ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ সবচে' বেশি অবহেলিত৷ সরকারি-বেসরকারি বলে শিক্ষায় যে বৈষম্যের পাহাড় রচনা করে রাখা হয়েছে তা শিক্ষাব্যবস্থার সবচে’ বড় কলঙ্ক৷ এ কলঙ্ক যতদিন না মোচন করা হবে, ততদিন শিক্ষা থেকে সুফল পাওয়া কঠিন৷

চলতি অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে শিক্ষক সমাজের, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্য এক আলাদা প্রত্যাশা ছিল৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে লালিত পালিত দলটি যখন পঞ্চমবারের মতো একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসীন তখন শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা মোটেও অলীক কিংবা অযৌক্তিক ছিল না৷ বঙ্গবন্ধু যেখানে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে দলিত-মথিত অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন সেখানে তারই কন্যার নেতৃত্বে চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামীলীগ সরকারের কাছে সর্বস্তরের জনগণের প্রত্যাশা যেমন অনেক, তেমনি শিক্ষক সমাজেরও প্রত্যাশা বহু বেশি৷ এটিই স্বাভাবিক৷ অন্তত সদ্য পাস হওয়া চলতি অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষদের প্রত্যাশা পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ না করা তাদের জন্য যেমন দুঃখ ও কষ্টের কারণ তেমনি জাতির জনক তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের জন্যও লজ্জার বিষয় বটে৷ অন্তত একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসীন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দলটি যদি মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরও জাতীয়করণ করতে না পারে, তাহলে অন্য কে পারবে? বঙ্গবন্ধু আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই জাতীয়করণ করে ফেলতেন সে বিশ্বাসটুকু সকলেই ধারণ করেন৷

এবার দশ হাজারের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও'র জন্য আবেদন করেছে৷ আমার মনে হয় এরা সকলেই এমপিও পাবার অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়া পূরণ করেছে৷ দু'-একটা হয়ত পারেনি৷ সুতরাং এদের সকলকে এমপিও দেবার উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য৷ দশ বছর পর এমপিও দেয়া হচ্ছে৷ আবার ক'বছর পর দেয়া হবে কে জানে? ফি বছর দিলে কোন কথা ছিল না৷ দু’-তিন হাজার প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিলে বাকিদের কী হবে? এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কী অভুক্ত আর উপোস থেকে শিক্ষা দেবে? এ হয় না৷ দয়া করে সবাইকে দিন৷ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কাউকে বাদ দিয়েন না,প্লিজ৷

অনেকদিন থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি আর পদোন্নতির কথা শুনে আসছি৷ কেবল শোনাটুকুই সার৷ টাইমস্কেলের পরিবর্তে দু’টো উচ্চতর স্কেলের কথা শোনা গিয়েছিল৷ তাতে স্কুলের শিক্ষকরা কিছুটা খুশি হলেও, কলেজের স্যারেরা নাখোশ৷ সেটিরও এখন খবর নেই৷

বেসরকারি শিক্ষকদের বোনাস এখনও ২৫ শতাংশ৷ এতবড় একটা মেগা বাজেট দেয়া হলো৷ অন্তত বোনাসটা শতভাগ করা যেত৷ এসব না করাতে আমাদের অক্ষমতা ও হীনমন্যতা প্রকাশ পায়৷ এ লজ্জা সমগ্র জাতির৷

ঈদুল আযহা প্রায় সমাগত৷ যে করেই হোক পুর্ণাঙ্গ বোনাসটি দিন৷ এক এক করে দ্রুত জাতীয়করণের পথে অগ্রসর হোন৷ উন্নয়নের অভিযাত্রায় শিক্ষা ও শিক্ষকদের সারথি করুণ৷ তা না হলে উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়৷

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক ৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027859210968018