বাড়ৈ সিন্ডিকেটের কব্জায় শিক্ষা প্রশাসন, প্রশ্নফাঁস ঠেকাবে কে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

শিক্ষা খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১০ বছরের সব অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে প্রশ্নফাঁস ও জিপিএ ফাইভ বিক্রি। সব সরকারের আমলেই কম-বেশি প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ থাকলেও গত পাঁচ বছরে তা যেন মহামারি আকারে দেখা দেয়। পরীক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্যরা ১০ বছর ধরে রয়েছেন। বাড়ৈ সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য দুর্নীতিবাজ, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন, শিবির, ছাত্রদল ও সুবিধাবাদী হিসেবে শিক্ষা প্রশাসনে চিহ্নিত। পক্ষান্তরে শিক্ষা ক্যাডারের আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা ১০ বছর ধরেই কোণঠাসা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এবং বিএনপি-জামাতের পাঁচ বছরও তারা কোণঠাসা ছিলেন। এবার তারা আশা করছিলেন ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় এবার বুঝি বাড়ৈ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমবে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল হবে। কিন্তু ২৪ মার্চের বদলি ও পদায়ন আদেশ দেখে তারা ফের হতাশায় নিমজ্জিত। শিক্ষা ক্যাডারসহ পুরো শিক্ষা প্রশাসনের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত তারা। তারা হিসেব কষে দেখেছেন ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তাদের জন্য শুধুই বঞ্চনা ও আর কোণঠাসা অবস্থা। অথচ অসীম সাহস নিয়ে স্বাধীনতা সংসদ গঠন করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগপন্থিরাই। 

প্রশ্নফাঁস, শিক্ষা ক্যাডারের পদ সৃষ্টি ও সরকারিকরণ প্রসঙ্গ

স্বাধীনতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সংসদের একজন প্রথম সারির নেতা দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, শিক্ষা খাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন কারা? সাবেক ছাত্রলীগাররা নাকি ছাত্রশিবির-ছাত্র ইউনিয়নিস্টরা? প্রশ্নফাঁস ঠেকাবেন কারা? শিক্ষা ক্যাডারের জন্য ১ম, ২য় গ্রেডের পদ এবং ৩য় গ্রেডের ৫০টি পদ সৃষ্টির কাজ করবেন কারা? বাড়ৈ সিন্ডিকেটের জুনিয়র অধ্যাপকদের শিক্ষা প্রশাসনের বড় পদে বসানোয় শিক্ষা ক্যাডারের এসব কাজ বন্ধ থাকবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও স্বল্পখরচে পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকার উপজেলা সদরে একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ করে। কিন্তু বাড়ৈ সিন্ডিকেটের সদস্যরা এর সুফল আওয়ামী লীগ সরকারকে ভোগ করতে দেয়নি। নানা অজুহাতে এসব প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করেছে বাড়ৈ সিন্ডিকেট। স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এর সুফল পায়নি। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবক সবাই অখুশি।

স্বাধীনতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সংসদের একজন যুগ্ম-আহ্বায়ক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, সদ্য সরকারি স্কুলের পদ সৃজনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন নারী কর্মকর্তার নিজ স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকেও ঘুষ নিয়েছেন শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। পদ সৃজন ঝুলিয়ে দেয়ায় শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ।

তিনি বলেন, অভিভাবকরা প্রশ্ন করেন, স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাহলে এখনও কেন বেসরকারি আমলের মতো বেশি টাকা টিউশন ফি দেবো? এ নিয়ে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ, এমনকি স্কুল-কলেজের প্রধানদের ওপর চড়াও হন। গত সপ্তাহে রাজধানীর শ্যামপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রাস্তায় নেমেছেন। তাদের দাবি প্রতিষ্ঠান সরকারি হওয়ার পরও তারা কেন বেশি টাকা ছাত্র বেতন ও অন্যান্য ফি দেবেন? সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানের পদসৃজন ও অ্যাডহক নিয়োগে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বিনিময় হচ্ছে। ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। ফাইল আটকায় বাড়ৈ সিন্ডিকেট।

সরকারিকৃত স্কুল শিক্ষক সমিতির সভাপতি শুধাংসু শেখর তালুকদার দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, শিক্ষা ভবনের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছে আমরা জিম্মি। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। যত বেশি টাকা ফাইলের মুভমেন্ট তত বেশি। প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ হলেও সুফল পায় না ছাত্র-শিক্ষক কেউ।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতির একজন নেতা বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে এসএসসির পরীক্ষার প্রথম দিনেই লেজে-গোবরে করে ফেলেছেন শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ১০ বছর ধরে আঁকড়ে থাকা বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্যরা। নতুন সমস্যায় ফেলেছেন নতুন মন্ত্রীদের।  

২৬ জনের পদায়ন নিয়ে মাঠের আলোচনা

২৪ মার্চ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন ধরে থাকা নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ১৮ জনকে ওএসডি করায় শিক্ষা খাতের প্রায় সবাই খুশি। কিন্তু বাড়ৈ সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্যকে পরীক্ষা ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট পদে বসানোয় ১৮ জনকে ওএসডির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে চান না কেউ। শিক্ষা ক্যাডারের আওয়ামী পন্থিরা মর্মাহত।

কীভাবে জুনিয়র অধ্যাপকদের সিনিয়র পদে বসানো হলো তা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে আলোচনার মধ্যে দুটি আলোচনা বেশ জোরেসোরে হচ্ছে। এক. বাড়ৈ সিন্ডিকেটের মাদকাসক্ত একজন সদস্য এই পদায়নের নেপথ্যে কাজ করেছেন। এই কর্মকর্তা কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখায় থাকাকালে এমন কোনো অঘটন নেই যা ঘটাননি। বর্তমানে তিনি চাঁদপুরের একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পদে রয়েছেন এবং মাদরাসা বোর্ড অথবা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে আসার সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। গত ২৪ মার্চ জারি করা ২৬ জনের পদায়নে অন্যতম নেপথ্য ভূমিকা পালনকারী একটি বেসরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষ। চাঁদপুর অঞ্চলের প্রভাবশালী ওই সাবেক ছাত্র ইউনিয়নিস্ট অধ্যক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের নেতা ছিলেন। বাড়ৈ সিন্ডিকেটের পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রশাসনে আওয়ামী পন্থিদের ‘সাইজে’ রাখারও দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সেই অধ্যক্ষ। 

বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্য চাঁদপুরের সেই বেসরকারি কলেজ অধ্যক্ষকে নিয়ে শিক্ষা ক্যাডার  কর্মকর্তারা নানা নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। প্রতিক্রিয়ায় সেই অধ্যক্ষ তার ফেসবুকে সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সরকারি চাকরিবিধির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি করেছেন। 
ছবি:  ফেসবুক থেকে সংগৃহীত 

বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্য চাঁদপুরের সেই বেসরকারি কলেজ অধ্যক্ষকে নিয়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা নানা নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। প্রতিক্রিয়ায় সেই অধ্যক্ষ তার ফেসবুকে সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সরকারি চাকরিবিধির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি করেছেন। 

দ্বিতীয় আলোচনাটি, টাকা লেনদেন সংক্রান্ত। ২৪ মার্চের বদলির আগে শিক্ষাজীবনে শিবির-ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রদল পন্থিদের ‘প্রকৃত আওয়ামী লীগার’ হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের। তারপর সুযোগ বুঝে ভালো পদে পদায়নের আদেশ জারি করানো হয়েছে। আরও হওয়ার অপেক্ষায়। তবে, ভালো পদায়ন পাওয়ায় বাড়ৈ সিন্ডিকেটের কতিপয় সদস্যকে টাকাও গুণতে হয়েছে। সর্বশেষ, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান পদের জন্য একজনের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘৫০ লাখ টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান হব না।’ 

জানা যায়, টাকা লেনদেনের দায়িত্বে থাকেন ওই সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী দুই সদস্য। ঢাকা বোর্ডের সচিবসহ বিভিন্ন পদে গত ১০ বছর ধরে থাকা মো. শাহেদুল খবিরকে কলেজ ও প্রশাসনের পরিচালক পদে বদলি করে আনা হয় ২৪ মার্চ। শিক্ষা ক্যাডারে শাহেদুলের সিনিয়র অধ্যাপক রয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার। ৭ম, ৮ম সহ বিভিন্ন ব্যাচের সিনিয়র অধ্যাপকদের এসিআর লিখবেন শাহেদুল খবির। এ নিয়ে সব সরকারি কলেজের সিনিয়র অধ্যাপকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। 

অপরদিকে, বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্যদের আরও ভালো ভালো পদায়ন হওয়ায় যারপরনাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন বিনা ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া বাড়ৈ সিন্ডিকেট প্রধান। আর আওয়ামীপন্থি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা চরম হতাশ। গত ১০ বছরে শিক্ষা প্রশাসনের কমিউনিস্ট ও ছাত্র ইউনিয়ন পন্থিদের দাপটে অস্থির থাকা আওয়ামী পন্থি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা নতুন করে হতাশ হয়েছেন। সদ্য সরকারিকৃত ২৯৯ কলেজ ও ৩১৫ স্কুল শিক্ষকরাও শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিহিংসাপরায়ণ বাড়ৈ সিন্ডিকেট সদস্যদের পদায়ন আদেশ দেখে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলোর নেতারাও। বাড়ৈ সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য বেসরকারি শিক্ষকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার অভিযোগ এনে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাড়ৈ সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য মো: আকতারুজ্জামান প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে তথ্য গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করে গ্রেফতার ও বরখাস্ত ছিলেন বহুবছর। বিএনপি নেতা ও বরখাস্ত অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূইয়ার সাথে দহরমমহরম করে পুরো বিএনপি জমানায় অবসর সুবিধা বোর্ডে চাকরি করেছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা সচিব এন আই খান তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করেন। কিন্তু সেই আকতারুজ্জামানকেই শারীরিক শিক্ষার উপ-পরিচালক পদে পদায়নে দেয়ায় বিস্মিত হয়েছেন শিক্ষা প্রশাসনের রুচিশীল সবাই। মোটা অংকের টাকা লেনদেনের বিষয় রয়েছে আকতারুজ্জামানের নতুপ পদায়নে। এ কথা সবার মুখে মুখে।

শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলিভিত্তিক পদায়নের আগে কর্মকর্তাদের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে নতুন মন্ত্রীদের বিনীত আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী পন্থি শিক্ষকরা। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদেরও একই অভিমত।

বিতর্কিতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসন্তোষের ঢেউ লেগেছে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার গায়েও। আলোচিত-সমালোচিত এই বদলির নেপথ্যে কারা ভূমিকা রেখেছেন, টাকার ভূমিকা কতটুকু তা খতিয়ে দেখার পর সরকারের শীর্ষ মহলকে জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা।

ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কী আদেশ হলো? যাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়ার কথা তারাই আরো কাছে, আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে, এটা কী করে হয়?’

২৬ জনের পদায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক এবং বিভিন্ন বোর্ড ও দপ্তর-অধিদপ্তরের পদগুলোতে সিনিয়র শিক্ষকদের পদায়নের বিধান আছে। মহাপরিচালক ও  পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) পদের জন্য এসএসবি করার বিধান রয়েছে। মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন)  কলেজ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ, সিনিয়র অধ্যাপকদের এসিআর লেখা, কাজের নির্দেশনা দেয়া ও সমন্বয় করাসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। এ কারণে এসব পদে সিনিয়র অধ্যাপকদের আশা করেন সাধারণ শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।

ঢাকার একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, অসংখ্য সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে পদায়ন করায় নেতিবাচক দৃষ্টান্তও তৈরি হয়েছে। এর ফলে জুনিয়রদের মধ্যে যে কোনো মূল্যে বড় পদে বসার প্রবণতাও তৈরি হবে। পাশাপাশি কলেজ ও শিক্ষা বিভাগের দপ্তরে এসব কর্মকর্তার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠদের আধিপত্য সৃষ্টি হতে পারে। সব মিলে প্রশাসন ও ক্যাডারের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাড়ৈ সিন্ডিকেটের কয়েকটি অপকীর্তি

বাড়ৈ সিন্ডিকেটের কয়েকটি অপকীর্তির মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তহবিলে গচ্ছিত ২০০ কোটি টাকা থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ৮০ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংকের বিতর্কিত শান্তিনগর শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে কতিপয় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ করিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানো। জুতা পায়ে শহিদ মিনারে ওঠা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া টাকার বিনিময়ে শত শত স্কুল-কলেজের একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদান অনুমতি দেয়া। জিপিএ ফাইভ বিক্রির অন্যতম হোতা অদ্বৈতকে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

জিপিএ ফাইভ বদলানো

বাড়ৈ সিন্ডিকেটের একজন নারী সদস্য ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখায় থাকাকালে নিজের মেয়ের প্রকৃত ফল ৪ পয়েন্ট ২৮ পাল্টে জিপিএ ফাইভ করে নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই নারী সদস্যের স্বামীর যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ঢাকা থেকে নদীপথে ১২০ মাইল দূরের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার বানানো হয়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রীর সাথে যৌন হয়রানির দায়ে তাকে বরখাস্ত করা হয় গত মাসে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দেও একই রকমের অপরাধ করেও শুধু বাড়ৈর তদবিরে পার পেয়ে যান সেই আসামী-স্বামী।  উল্লেখ্য, ঢাকা শিক্ষাবোর্ড থেকে জিপিএ ফাইভ বিক্রি শুরু হয় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। 

অনলাইনে কলেজ ভর্তির বিরোধীতা 

কলেজ ভর্তিতে দুর্নীতিরোধ ও ভোগান্তি কমানোর লক্ষ্যে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি অনলাইনে করার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন শিক্ষাসচিব এন আই খান। কিন্তু ঘুষ খেয়ে হাবিজাবি কলেজ অনুমোদন ও স্বীকৃতি রক্ষার তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে শিক্ষাবোর্ড গুলোতে জেঁকে বসে থাকা বাড়ৈ বাহিনীর সদস্যরা অনলাইনে ভর্তির তীব্র বিরোধীতা করেন। অনলাইন পদ্ধতিটিকে ব্যর্থ প্রমাণ ও এন আই খানকে ‘সাইজ’ করতে গিয়ে পুরো সরকারকেই বেকায়দায় ফেলে বাড়ৈ বাহিনী। যদিও এন আই খান প্রবর্তিত অনলাইন পদ্ধতিটিই শিক্ষা খাতে আওয়ামী সরকারের সফলতার অন্যতম উদাহরণ। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াধীন কলেজগুলোতেও অনুসরণ করা হয়।   

খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে যাওয়া 

বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে তার গুলশানের রাজনৈতিক অফিসে রাতের বেলায় দেড় শতাধিক শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার গোপন বৈঠক করেন নাছরিন গংরা। শিক্ষা ক্যাডার সমিতিতে নজিরবিহীন ওই অপরাধের দায়ে কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে তৎকালীন বিসিএস শিক্ষা সমিতির নির্বাচিত নেত্রী বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের শ্যালিকা অধ্যাপক নাছরিনের নেতৃত্বে খালেদার সাথে অনুষ্ঠিত ওই সভায় যোগদানকারী কারো বিরুদ্ধে শোকজও করা হয়নি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসলে বাড়ৈ সিন্ডিকেটের সবাই ‘ভালো’ থাকবেন এই চুক্তিতে শোকজ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে আওয়ামী পন্থি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা দৈনিক শিক্ষাকে বলেছেন। 

তারেক জিয়ার কানেকশন রক্ষা প্রসঙ্গে 

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে গভীর শোকাহত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা কাজী মো. আবু কাইয়ুম (শিশির) একটি নিবন্ধ লেখেন দৈনিক নয়া দিগন্তে। তারেক ও কোকোকে দেবতার সাথে তুলনা করে লেখা নিবন্ধটির একটি ইংরেজি অনুবাদ ঢাকাস্থ কয়েকটি বিদেশী দূতাবাসে পাঠিয়ে দেন কাইয়ুম। ফিনিক্স পাখির মতো কোকোর পুনরুত্থান এবং প্রতিশোধের ইঙ্গিতপূর্ণ নিবন্ধটি উসকানিমূলক মনে করেন কয়েকজন আওয়ামী পন্থি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। বিষয়টি তৎকালীন শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খানের নজরেও আসে। আওয়ামী পন্থি কর্মকর্তারা কাইয়ুমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবিতে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত নিবন্ধের কপিসহ লিখিত অভিযোগ দেন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ওই অভিযোগের কপি মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব হয়ে যায়। শত খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে ফের আবেদন জমা দেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় জমা দেয়া অভিযোগও হাওয়া হয়ে যায়। অভিযোগ খোয়া যাওয়ার পেছনে বাড়ৈ সিন্ডিকেট প্রধানের ইশারা রয়েছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ২০০১ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মহা দাপুটে ছিলেন কাজী কাইয়ুম। এই কাইয়ুমের বদৌলতে বিএনপি-জামায়াত জমানায়ও পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে মহা দাপটের সাথে চাকরি করেন বাড়ৈ সিন্ডিকেট প্রধান।

তারেক জিয়ার কানেকশন, শিক্ষা ক্যাডারে বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে কাইয়ুমকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে নীলফামারি সরকারি কলেজে বদলি করা হলেও একদিনের জন্য সেখানে যাননি। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। কয়েকটি অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় কাইয়ুমকে চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় কাজী কাইয়ুমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের নথি খুঁজে পান না কেউ। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কাইয়ুমের বিরুদ্ধে আনীত প্রকৃত  অভিযোগের তথ্য গোপন করে রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন পাঠানো হয় বাড়ৈর ইশারায়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে কাইয়ুমকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক জিয়ার নির্দেশে বিএনপি-জামায়াতপন্থি সরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের নিয়ে গোপন সংগঠন তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালনের অভিযোগ ওঠে কাজী কাইয়ুমের বিরুদ্ধে। প্রায় চার বছর ধরে কাগজে-কলমে তার পদায়ন পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজে হলেও তাকে বেশিরভাগ সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এবং কূটনৈতিক পাড়ায় দেখা যায়। পাঁচ বছরের জন্য লন্ডনের ভিসা পাওয়া কাইয়ুমকে বাড়ৈ সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যের সাথে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবেও দেখা যায়। ট্যাব গঠন করায় কাইয়ুমের বিরুদ্ধে কোনও টু শব্দ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বধীনতা বিসিএস সংসদ গঠন করায় আওয়ামীপন্থিদের বিরুদ্ধে বিষোদগার আর মিথ্যাচার শুরু করে বাড়ৈ সিন্ডিকেট। যা এখনো অব্যাহত।  

গত সপ্তাহে শিক্ষা অধিদপ্তরের তিন তলায় বাড়ৈ সিন্ডিকেটের এক সদস্যের সাথে গোপন আলাপরত দেখা যায় কাজী কাইয়ুমকে। লন্ডনে যাওয়ার জন্য ছুটি দরকার কাইয়ুমের। লন্ডনে অবস্থানরত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ কাজী কাইয়ুম শুধু লন্ডন যাওয়ার জন্য ছুটি চাইলে সন্দেহ হতে পারে তাই তাকে ভিন্ন পরামর্শ দেন বাড়ৈ সিন্ডিকেটের এক সদস্য। কাইয়ুমের ছুটির আবেদনে যুক্তরাজ্য, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের কথা উল্লেখ করার পরামর্শ দেয়া হয়। অর্ধগড় বেতনে তার এপ্রিলের শুরু থেকে ৪৫ দিনের ছুটির আবেদনটি অনুমোদন হয়ে যাবে যে কোনো সময়। 

সংসদীয় কমিটির কাছে নালিশ

২৪ মার্চের আদেশে অভিযুক্তদের ভালো পদে বসানোয় সংক্ষুব্ধরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কয়েকজন সদস্যের কাছে। ‍সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের বদলি ও ২৪ মার্চের আদেশ রিভিউ দাবি করেন তারা।  আগামী ৩ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় কমিটির দ্বিতীয় সভায় বিষয়টি আলোচনার জন্য কয়েকজন সংসদ সদস্যকে অনুরোধ করেছেন আওয়ামীপন্থি কয়েকজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0091280937194824