বিজ্ঞান শিক্ষা কেন প্রয়োজন

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

এক অজানা আকর্ষণবলে কয়েক কোটি বছর ধরে পৃথিবী নামক একটা গোলাকার গ্রহের বহিঃপৃষ্ঠে আমরা সেঁটে আছি, সেটা আবার খানিকটা হেলানো অবস্থায় ঝুলে থেকে নিজ অক্ষের উপর ভর করে ক্রমাগত ঘুরছে! গভীর সমুদ্রের হাজার হাজার ফিট পানির তলদেশে অন্ধকারে মাছসহ অন্যান্য অনেক প্রাণী আলো ও অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে বিচরণ করছে, অথচ ভূপৃষ্ঠের উপরিতলে অক্সিজেন ব্যতিরেকে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। পাঠকবৃন্দ আপনারাই ভেবে দেখুন প্রকৃতির কাছে আমাদের কল্পনাশক্তি কতটাই তুচ্ছ!

সৃষ্টির আদিকাল থেকে যে পৃথিবী ছিল অপার বিস্ময় ও রহস্যের স্থান, সে পৃথিবীকে মানুষ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যেন মানুষের কাছে অসম্ভব বলে আর কিছুই নেই। প্রাচীনকালে জীবনযাপনের এক পর্যায়ে মানুষ পাথরে পাথর ঘষে আগুন আবিষ্কার এবং পশুশিকারের জন্য অস্ত্র হিসেবে গাছের ডাল ও পাথর ব্যবহার করতে শেখে। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। তারপর থেকে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মনোনিবেশ করছে। 

আদিম যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানবসভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি আবিস্কারের ফলে মানুষ চাঁদে পাড়ি দেয়াসহ ও নানা বিষ্ময়কর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আজকের বিশ্বায়নের প্রাক্কালে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো বিজ্ঞানকে চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে মানবকল্যাণে নিত্যনতুন জিনিস আবিষ্কার করে চলেছে। বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করেই মানুষ চন্দ্রবিজয় করেছে এবং মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে নিজেদেরকে একটি সম্মানজনক আসনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে জেমস ওয়াট স্টিম-ইঞ্জিন এবং জর্জ স্টিভেন্স রেলগাড়ি আবিষ্কার করেছেন; জন এল বেয়ার্ড টেলিভিশন এবং চালর্স ব্যাবেজ কম্পিউটার আবিষ্কার করেছেন। বিদ্যুৎ, আণবিক শক্তি, মহাকাশ গবেষণা, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতির কল্যাণে মানুষ আজ পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাশূন্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য মনোনিবেশ করছে। আর্কিমিডিসের সূত্র ব্যবহার করে করে নানান জলযান তৈরি করে বিজ্ঞানীরা সমুদ্র বিজয় করেছে। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, মাইকেল ফ্যারাডে, টমাস আলভা এডিসন, আলবেরুনির মতো বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় মানুষ আধুনিক যুগে পদার্পণের সুযোগ পেয়েছে। বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর, অকল্পনীয় ও সীমাহীন অগ্রগতির ফলে আমাদের সমাজ-জীবনে এসেছে গতিময়তা। বিজ্ঞানের সব আশ্চর্র্য আবিষ্কার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এনে দিয়েছে অনাবিল সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য।

বিজ্ঞানশিক্ষা আমাদের নিজেদেরকে জানার ও নিরাপত্তার সুযোগ করে দিয়েছে। নিজ শরীরের অঙ্গসমূহ কীভাবে কাজ করে তার কতটুকুই বা জানি! খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে চার ধরনের দাঁত চার রকমের কাজ করে, আর জিহ্বা এই কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। মুখগহবরের চারপার্শ্বের গ্ল্যান্ডগুলো রস নিঃসৃত করে খাবার গলাধঃকরণের সময় আলজিব সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পাকস্থলিতে প্রেরণ করে। পাকস্থলির পাকরস খাদ্যকে অম্লীয় করে, যা শরীরের মৃদু কম্পনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পায়ুপথ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এই পথ অতিক্রমকালে যকৃত ও অগ্নাশয়ের রস খাবারকে ক্ষারীয় করে শোষণে সহায়তা করে। বিভিন্ন এনজাইম এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে এবং হরমোন শরীরবৃত্তীয় কার্য সম্পাদনে কাজ করে। অসংখ্য রক্তনালী আন্ত্রিক অঞ্চলে পরিবাহিত হয়ে খাদ্য থেকে পুষ্টি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে হৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ এবং ফুসফুস কর্তৃক অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ।

স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিস্ক মানুষের আবেগপ্রবণ অভিব্যক্তি, সমস্যার সমাধান, স্মৃতি, ভাষা, বিচার ও বিবেচনা এবং পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে চারপাশের পরিবেশ, আমাদের নিজেদের অবস্থান ও গতির নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। একজন ব্যক্তি প্রয়োজনে অন্য ব্যক্তিকে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে নির্দিষ্ট সময়-অন্তর রক্তদান করতে পারবে কারণ দেহে অক্সিজেন সরবরাহকারী লোহিত রক্তকণিকা মাত্র ৪ মাস বেঁচে থাকে। আবার রোগ-প্রতিরোধক্ষম শ্বেত রক্তকণিকা ১২ ঘণ্টার পর বেঁচে থাকতে পারে না। একজন স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান মানুষ ২৪ ঘণ্টায় ২৩ হাজার ৪০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, হৃৎপিণ্ড ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৮০ বার স্পন্দিত হয় এবং ৭ হাজার ৫০০ লিটার রক্ত পাম্প করে। মস্তিষ্কের ৭০ লাখ নিউরন কোষ সারাক্ষণ কাজ করে। জন্মের প্রথম দু’বছর একটি মানব শিশু হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় ১৫০ কি.মি. দূরত্ব অতিক্রম করে, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে যেমন ফুসফুস আবশ্যক তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকবেলায় উদ্ভিদরাজির উপস্থিতি অত্যাবশ্যক ইত্যাদি ইত্যাদি এ সবই বিজ্ঞানশিক্ষার তথ্য।

বর্তমান এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানশিক্ষা ছাড়া স্বনির্ভরতা অর্জন সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উদ্ভাবনীর কারণে আজ বিশ্বব্যাপী যোগাযোগে, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রসারে, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও বিনোদনের ক্ষেত্রে সীমাহীন অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। যেমন, পরিধেয় বস্ত্র, কালি, কলম, কাগজ, ঔষধপত্র, কৃষি উৎপাদন, খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও ব্যবহার, খাবার তৈরির জন্য গ্যাস, স্টোভ, বৈদ্যুতিক চুল্লি, খাবার গরম করার জন্য ওভেন, সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর, বিনোদনের জন্য টেলিভিশন, রেডিও, ভিসিডি, ডিভিডি, টেলিফোন, ই-মেইল, ফ্যাক্স, বিভিন্ন যানবাহন, বিমান, সোলার-চালিত যানবাহন, ছাপাখানা, ফটোকপিয়ার, প্রিন্টার, চিকিৎসা ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি বিজ্ঞানেরই অবদান। আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের আবিষ্কৃত টেলিফোনের পরবর্তী সংস্করণই আজকের বিশ্বের বিস্ময়কর ও বহুবিধ সার্ভিস প্রদানকারী উপকরণ র্স্মাটফোন। কম্পিউটার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও মহাকাশ অভিযানসহ জীবনের সকল স্তরে যুগান্তকারী ও বিস্ময়কর অগ্রগতি বিজ্ঞানশিক্ষারই ফসল। সুতরাং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং জীবনচলার পথকে সুন্দর করার জন্য চাই বিজ্ঞানশিক্ষা।

বিজ্ঞানশিক্ষা মানুষের মনের সংকীর্ণতা ও ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে সত্যের সন্ধান দেয়। সূর্য পূর্বদিকে উঠে এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যায়, আর পৃথিবী নামক গ্রহটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেমানুষ এটাই জানত। কিন্তু বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস আবিষ্কার করলেন সূর্যটা দাড়িয়ে আছে এবং পৃথিবীসহ সৌরজগতের আরো অসংখ্য গ্রহ তার চারপাশে নিজস্ব দূরত্ব বজায় রেখে ক্রমাগত ঘুরছে। সুতরাং একমাত্র বিজ্ঞানচর্চাই মানুষের অজ্ঞতা দূরীভূত করতে পারে। এভাবেই মানুষ যুক্তিবাদী ও বিচারবোধ সম্পন্ন হয়ে ওঠে, যারা বিজ্ঞানশিক্ষা অর্জন করছেন, তারা কখনো ঝার-ফুঁক দেয়া, তাবিজ দেয়া, মানত করা, জিন-ভূত চালনা করা, চাউল পড়া বা বাটি চালান দিয়ে চোর ধরা, কাক বা পেঁচা ডাকলে অমঙ্গল হওয়া, মন্ত্র দিয়ে সাপে কাটা রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিতরা যে কোনো ঘটনা বা সমস্যার প্রকৃত কারণ জানতে সচেষ্ট হয়। কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকল্প নেই।

বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ জল-স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে, সর্বক্ষেত্রে আজ বিজ্ঞানের জয়যাত্রা পরিলক্ষিত। ‘শিক্ষাপদ্ধতি ও নেতৃত্বের গুণাবলি’ নামক প্রবন্ধে বলা হয়েছে- গণিত, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান, প্রকৌশল, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূ-তত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব,স্থাপত্য ও কম্পিউটার-বিজ্ঞান প্রভৃতির উদ্ভব হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন থেকেই। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অসংখ্যবার সমুদ্র, নদী, উদ্ভিদ, পানি, মাটি, পৃথিবী, ঝরনা, পাখি, মহাকাশ, তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টির গুরুত্ব নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক চর্চার ফসলচার্লস ডারউইনের বিবর্তন মতবাদ মানবজাতির মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, সেটাকে কোনোভাবে আড়াল করা যাবে না। একটা মৃত গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্বই ছিল না, সেখানে ক্রমাগত ও ধারাবাহিক পরিবর্তন সংগঠন, এক অকোষীয় জীব বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নতুন জটিলতর বহুকোষী জীবের সৃষ্টি, তাদেরই একজন আমি। বিজ্ঞানীরা ভাবেন শ্রেষ্ঠজীব মানুষের নতুন কিছু করার কতটুকু সম্ভাবনা ছিল আর কতটুকুই বা করতে পেরেছে, হয়ত আরো নতুন কিছু করা যেত! অতীতের মানুষগুলো তাঁদের স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যতের আশা খুঁজে বেড়াত। মানুষের স্বপ্ন ছিল পাখির মতো আকাশে উড়বার। রাইট ব্রাদার্স উড়োজাহাজ আবিষ্কার করে মানুষের সে স্বপ্ন পূরণ করেছেন। মানুষ একদিন স্বপ্ন দেখত কীভাবে অন্ধকার তাড়ানো যায়। মাইকেল ফ্যারাডে, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন ও টমাস এলভা এডিসনের বৈজ্ঞানিক চর্চার সাফল্য সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। এককথায়, মানবসভ্যতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শহর-ব্যবস্থাপনা, বিগ ডাটা বিশ্লেষণ, আবহাওয়া, সাইবার নিরাপত্তাসহ অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। এ প্রযুক্তি আবার আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন স্টিফেন হকিং, এলন মাস্কসহ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রবক্তারা।

বর্তমানে প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষকরা চক, ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ডের পরিবর্তে মাল্টিমিডিয়া রুমে ক্লাস নিচ্ছেন। এতে শিক্ষকরা তাদের তৈরি করা ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, অ্যানিমেশন কোনো একটি অনলাইন প্ল্যাটফরমে শেয়ার করেন এবং অন্যরা প্রয়োজন মতো তা ডাউনলোড করে নেন। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারাবিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের বই, গবেষকদের জার্নাল, শিক্ষাবিষয়ক কন্টেন্ট, নতুন নতুন আর্টিক্যাল সম্পর্কে মুহূর্তের মধ্যেই জানতে পারে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পিকার স্থাপন করে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’ তৈরি করে কঠিন, দুর্বোধ্য ও বিমূর্ত বিষয়গুলোকে ছবি, অ্যানিমেশন ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করে থাকেন। অনলাইন কোর্সের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা ইত্যাদি সফলভাবে সমাপ্ত করে সনদ লাভ করা যায়। এছাড়া প্রযুক্তির বদৌলতে ঘরে বসেই এখন বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে রোবটিকস, বিগ ডাটা অ্যানালিটিকস কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট রয়েছে, যার মাধ্যমে হাজিরা থেকে শুরু করে ফলাফল সবই ঘরে বসে সম্পন্ন করা সম্ভব।

পৃথিবীতে কিছু ক্ষুদ্র জীব রয়েছে যাদের আমরা খালি চোখে দেখি না, তবে এদের প্রভাব মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর অত্যন্ত শক্তিশালী। মাটিতে অবস্থিত অণুজীবরা জৈব বর্জ্যকে পচিয়ে পরিবেশকে সুন্দর রাখে। একই সাথে মাটি, বায়ু, পানি আর জীবনের মাঝে নানা রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিছু অণুজীব সালোকসংশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যারা জীবজগতে খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। আমাদের গৃহীত খাদ্যের হজম ও তা থেকে শক্তি সঞ্চয় প্রক্রিয়াটি অণুজীব ছাড়া অসম্ভব! ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে ভিনেগার, মদ, এলকোহলিক বেভারেজ, সয়া সস, পনির, দই, পাউরুটি ইত্যাদি খাদ্য তৈরিতে অণুজীব ব্যবহার করা হয়।

আলেকজেন্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনক্সিমিথাইল পেনেসিলিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। বিজ্ঞানশিক্ষার বিস্ময়কর অবদান হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা। পূর্বে অনুজীব দ্বারা সৃষ্ট গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, যক্ষা, পোলিও, নিউমোনিয়া প্রভৃতি রোগের কারণে মহামারী দেখা দিত, যা বিজ্ঞানের প্রভাবে দূর করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে দেখা দেয়া করোনা ভাইরাসের আতঙ্কও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই দূরীভুত হবে। এক্স রে, ইসিজি, সিটিস্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এম.আর.আই প্রভৃতি যন্ত্রের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। আল্ট্রাসনিক স্ক্যানিং-এর মাধ্যমে শরীরের ভেতরের যকৃত, পিত্তথলি, কিডনি ইত্যাদির অবস্থান নির্ণয়, লেজার সার্জারির মাধ্যমে দ্রুত অপারেশন, ফাইবার অপটিক্যাল ব্যবহার করে ফুসফুস, পাকস্থলি, বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, উদর, শিরা-ধমনীর অবস্থা নির্ণয় করে চিকিৎসা করা যায়। বিজ্ঞানশিক্ষার ফলে অন্ধবিশ্বাস দূর হয়েছে, মানুষ এখন উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছে। বিজ্ঞানশিক্ষার ফলে দুরারোগ্য ব্যাধিতেও মৃত্যুর হার কমেছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে।

বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নয়নের কারণে জমিচাষে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার এবং সেঁচকাজে বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত পাম্প ব্যবহার করে কৃষিবিজ্ঞানীরা কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়েছে। উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কারের ফলে সারা বছরই ধান, বিভিন্ন জাতের ফল ও শাক-সবজি ফলানো সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে যান্ত্রিক নৌকা, যন্ত্রচালিত আখ-মাড়াই মেশিন, নানান জাতের ফসল উত্তোলন ও রোপন করার মেশিন, রাইসমিল, পাওয়ার লুম, যন্ত্রচালিত তাঁত, আধুনিক যানবাহন, বিদ্যুতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবহারিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে আজকাল মাছচাষ, গরু, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, ছাগল-পালন ইত্যাদি প্রকল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অনেকেই সাফল্য লাভ করছে। বর্তমানে মৎস্য-উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ, খাদ্য-উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এবং শাক-সব্জি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। এসব উন্নয়ন সবই বিজ্ঞানের ও গবেষণার অবদান।

কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে। অথচ উন্নয়ন ও উৎপাদনবিমুখ পরিকল্পনার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। অতীতে জাপান জার্মানি থেকে পণ্য আমদানি করত, এখন সে-সকল কাচাঁমাল মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত কিংবা চীন থেকে আমদানি করে। ভারত আইআইটি স্থাপনের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়েছে, ফলে তারা চাঁদে রকেট পাঠিয়ে প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারব না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথটিই আমাদের উন্নয়নের পথ।

বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কখনও বাস্তবায়িত হবে না। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবটি ছিল ডিজিটাল বিপ্লব। এখন অপেক্ষা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সফল করতে হলে শিক্ষার্থীদের হতে হবে যুগোপযোগী শিক্ষায় দক্ষ। আমাদের দেশে পরমাণু-জ্ঞানসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের দরকার। ন্যানো টেকনোলজি এখন আমাদের চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে বহুকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যে জাতি বিজ্ঞানশিক্ষায় যত বেশি অগ্রসর, তারা তত বেশি উন্নতি লাভ করছে। এই তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের অংশীদার হয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দারিদ্র্য-বিমোচনের একটি অভাবনীয় সুযোগ পেয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার করে রাষ্ট্রপরিচালনায় স্বচ্ছতা এনে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এ দেশের বিজ্ঞানশিক্ষায় অধিক পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ, জনসচেতনতা, সেইসাথে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

লেখক: ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073089599609375