নির্বাচন ঘিরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা থাকলেও নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই দেশের সব শিক্ষার্থী হাতে পাবে বিনামূল্যের পাঠ্যবই। ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ এখন পুরোদমে চলছে। গতকাল পর্যন্ত মোট ৩৫ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ২৫ কোটির বেশি বই ছেপে সরবরাহ করেছেন ছাপাখানার মালিকরা। গড় হিসেবে প্রায় ৮০ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে জেলা ও উপজেলায়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
নতুন শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের চার কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট বইয়ের সংখ্যা ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে বিদেশি দুটিসহ মোট ৫৪টি প্রতিষ্ঠান এবং মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপাতে ১৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয় এনসিটিবি।
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল বলেন, ‘এখন যেভাবে ছাপার কাজ এগুচ্ছে তাতে নভেম্বরের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ বই উপজেলা পর্যায়ে চলে যাবে। ৮/১০টি প্রতিষ্ঠান কিছুটা দেরিতে কার্যাদেশ পেয়েছে; তাদের বইও ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুল পর্যায়ে চলে যাবে।’
আগামী ১০ ডিসেম্বরের আগেই ৯৯ শতাংশ বই স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হবে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের পরে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে কিছু বই ছাপার জন্য ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে এনসিটিবি।
গতকাল পর্যন্ত ২৫ কোটির বেশি বই সরবরাহ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আরও ৪/৫ কোটি কপি বই বাঁধাই পর্যায়ে রয়েছে। মোট কথা পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের অবস্থা খুবই ভালো। বইয়ের মানও ভালো হচ্ছে।’
এনসিটিবির সূত্র জানায়, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) এবং এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের ছয় কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬২ কপি বইয়ের শতভাগ ইতোমধ্যেই সরবরাহ সম্পন্ন হয়েছে। ৩৪০টি লটে এসব বই ছাপার কাজ দেয়া হয়েছিল।
মাধ্যমিক বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন, এবতেদায়ি, দাখিল, এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল এবং কারিগরি (ট্রেড বই) স্তরের ১৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫৫ কপি বইয়ের মধ্যে ইতোমধ্যে আট কোটি ৯৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮২৬ কপি বই সরবরাহ সম্পন্ন হয়েছে। এসব বই ১৮৮টি লটে ছাপা হচ্ছে।
দেরিতে মুদ্রণ কাজ শুরু করায় শাস্তি
এনসিটিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বই সরবরাহের কাজ নিয়ে দেরিতে ছাপার কাজ শুরু করায় তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। এর জবাব পাওয়ার পর আর্থিক জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে। এর মধ্যে হক প্রিন্টিং প্রেস, নিবেদিকা প্রিন্টিং প্রেস, এআরটি প্রিন্টিং প্রেস অন্যতম। একই অভিযোগে অনুপম প্রিন্টিং প্রেসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়াও নি¤œমানের কাগজে বই মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কারণে ‘রায়ান’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে চার হাজার কপি বই বাতিল করে পুনরায় ছাপাতে প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করেছে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১ হাজার কপি বই কেটে ফেলা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ছাপার কাজে যার যে রকম অনিয়ম, গাফিলতি বা ভুল-ত্রুটি হচ্ছে সে অনুযায়ী পিপিআর’র বিধিবিধান অনুসরণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কেউ চুক্তি লঙ্ঘন করে দেরিতে বই সরবরাহ করলে তাদেরও আর্থিক জরিমানা করা হবে। এক কথায় মান রক্ষায় কোন ছাড় নয়।’
উপানুষ্ঠানিকের বই ৩২ লাখ কপি
এনসিটিবি সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) সম্প্রতি উপানুষ্ঠানিক (নন-ফরমাল এডুকেশন) শিক্ষার জন্য ১ম ও ২য় শ্রেণীর প্রায় ৩২ লাখ কপি বই ছাপার চাহিদাপত্র দিয়েছে। আটটি বিভাগে এসব বই সরবরাহ করা হবে।
আগামী জুন-জুলাই থেকে উপানুষ্ঠানিক বইয়ের প্রয়োজন হবে জানিয়ে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এই বইয়ের সংখ্যা ৩২ লাখের কিছু বেশি। পিপিআর অনুযায়ী, যারা কাজ পাওয়ার যোগ্য তাদেরই এসব বই ছাপার কার্যাদেশ দেয়া হবে। এতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে পারে; আবার দেশি প্রতিষ্ঠানও পেতে পারে।’
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘উপানুষ্ঠানিক বেশির ভাগ বইয়ের কাজ পাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কারণ তারা অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে কার্যাদেশ নিয়ে ইতোমধ্যেই ভালোমানের বই সরবরাহ করেছে। কিন্তু দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চড়া মূল্যে বই ছেপে এখন উপানুষ্ঠানিক বইয়ের কাজও পেতে চাচ্ছেন।’
২০১৯ শিক্ষাবর্ষের মোট পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার ২০ কপি। আর প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৮৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৯ কপি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বই দুই লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৪ কপি, ইবতেদায়ির দুই কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার ২৮৩ কপি এবং দাখিলের তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৪ কপি ছাপা হচ্ছে।
মাধ্যমিক (বাংলা ভার্সন) স্তরের ১৮ কোটি ৫৩ হাজার ১২২ কপি এবং একই স্তরের ইংরেজি ভার্সনের ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৬ কপি বই ছাপা হচ্ছে।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষা স্তরের ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪৮ কপি, এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের এক লাখ ৪৩ হাজার ৮৭৫ কপি, ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক পাঁচ হাজার ৮৫৭ কপি এবং সম্পূরক কৃষি (৬ষ্ঠ-৯ম) স্তরের এক লাখ ২৪ হাজার ২৬১ কপি বই ছাপা হচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক সংবাদ