বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস আজ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। নারী-পুরুষ-শিশু সব বয়সী মানুষই এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। শহরাঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামাঞ্চলেও এ ঘাতকব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও দুটি সংস্থাই বলছে, আক্রান্ত হয়েও প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই জানেন না যে তিনি ডায়াবেটিস বহন করছেন। আবার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। এতে করে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, ডায়াবেটিক সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্প পরিচালনা করে দেখা গেছে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত প্রতি দু'জনের একজন জানেন না তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব। বড় ধরনের অসুস্থতা ছাড়া অধিকাংশ মানুষ শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অভ্যস্ত নন। বিশ্বের অনেক দেশ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট উদ্যোগী এবং বিভিন্ন মাত্রায় সফল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। তারা তুলনামূলক খারাপ জীবনযাপন করছে। 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সফলতার হারও অনেক কম। ডায়াবেটিসের দীর্ঘকালীন জটিলতায় বাংলাদেশি রোগীরা বেশি ভুগছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হলো, অতি অল্প বয়সীরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। 

কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে বসবাস করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। 

ডা. আজাদ খানের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল দু'জন চিকিৎসকের গবেষণায়। গবেষণায় তারা দেখতে পেয়েছেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণের মাত্রাও হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৭ সালে ডিআইএবি, কেয়ার এশিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে অধ্যাপক ডা. জাফর আহমেদ লতিফের এক গবেষণায় ২১ দশমিক ৮ শতাংশ আক্রান্তরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিমের এক গবেষণা দেখা যায়, ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ আক্রান্ত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে। দুটি গবেষণাতেই আক্রান্তদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, ডায়াবেটিসের মেয়াদকাল, ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য রোগের উপস্থিতি, চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের কম প্রবণতা, আক্রান্তের ভঙ্গুর মানসিকতা, ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত শিক্ষাগ্রহণে অনীহাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পথে বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিষয় সম্পর্কে আক্রান্তদের সচেতন করে তুলতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ৭০ ভাগে উন্নীত করা সম্ভব জানিয়ে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, অন্যথায় ভবিষ্যতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের সেবা দিতে ডায়াবেটিক সমিতি 'গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা প্রকল্প' নামে একটি নতুন প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর আজিমপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জে ২০০১-২০১২ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক হাজার অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ওপর দুটি পৃথক জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মধ্যে ১৯ শতাংশ এবং সব অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে ২২ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এসব মায়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ এক বছরের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে এবং ৩২ শতাংশ প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থায় রয়েছেন।

এই প্রকল্পের পরিচালক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক জানান, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের অর্ধেকেরও বেশি পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং ওই শিশু পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেশি থাকে।

দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী অপরিকল্পিত গর্ভধারণ করেন- এমন তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, গর্ভধারণের ৮ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর গঠন-প্রকৃতি নির্ধারণ হয়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা মা ১২ সপ্তাহ বা তারও পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ওই সময় সাধারণত কিছু করার থাকে না। গর্ভধারণের আগে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিলে মা ও শিশু উভয়ই সুরক্ষিত থাকবে।

ডায়াবেটিসে প্রতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। 

আইডিএফের ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। 

বাডাস বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫ লাখের বেশি নিবন্ধিত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। সারাদেশে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম স্থানে। বৃদ্ধির এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে পৌঁছাবে। দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া রোগটিকে এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ২০৩৫ সালে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞরা।

ডায়াবেটিসের এমন চিত্র সামনে রেখে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'ডায়াবেটিস প্রতিটি পরিবারের উদ্বেগ'। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিসের কারণে প্রতি বছর ৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ডায়াবেটিসের কারণে অর্থনৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়াবেটিসের ওষুধ, ইনসুলিন সব কিছুরই দাম দিন দিন বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল ডায়াবেটিসের হার কমাতে পারলে স্বাস্থ্য খাতেই ১১ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব।

ডায়াবেটিস কী, কেন হয় : ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। মানবদেহে ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতি হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহূত না হলে বা শরীরের ইনসুলিন নিষ্ফ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ গ্লুকোজ পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থার নামই ডায়াবেটিস। ঘন ঘন প্রস্রাব, স্বল্প সময়ে ওজন কমে যাওয়া, অধিক তৃষ্ণা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, অতিশয় দুর্বল ভাব, অতিরিক্ত ক্ষুধা এবং ক্ষত না শুকানো কারও শরীরে এসব লক্ষণ পাওয়া গেলে বুঝতে হবে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।

বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্তের দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যদক্ষতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি বিকল, অন্ধত্ববরণ, পায়ে পচন ধরতে পারে। বৈশ্বিক এ স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে ব্যাপকভিত্তিক জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। সময়মতো খ্যাদাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগসহ যেসব অসংক্রামক ব্যাধি আছে, সেসব রোগ মোকাবেলায় সরকার জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারি হাসপাতালেও মানুষ যাতে ডায়াবেটিস রোগের উন্নত সেবা পায়, তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0092940330505371