বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা : শিক্ষকদের রঙের রাজনীতি কাদের স্বার্থে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের দলভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের। বলা হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের যে আধিপত্যের রাজনীতি, শিক্ষক প্রশাসন সেখানে এর বিপরীতে অবস্থান না নিয়ে বরং অনেকক্ষেত্রেই সহযোগীর ভূমিকা নিয়ে থাকে। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বিবিসি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন তাফসীর বাবু।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে কিংবা পদ ঠিক রাখতে শিক্ষকরা আরো বেশি করে রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকদের এভাবে কোন একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ৩টি দল আছে। সাদা, নীল এবং গোলাপী। এই তিনটি দলই তিন ধরণের রাজনীতির প্রতি অনুগত। সাদা দলের ব্যানারে যেসব শিক্ষক রয়েছেন তারা বিএনপিপন্থি, নীল দল আওয়ামীপন্থি এবং গোলাপী দল বামপন্থি হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশের বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা এভাবেই বিভিন্ন নামে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে রাজনীতি করে থাকেন।

এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও এখন শিক্ষকদের এ ধরণের রাজনীতি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনে ছাত্রলীগের যে আধিপত্যের রাজনীতি এর পেছনে দায় আছে সেখানকার শিক্ষক প্রশাসনেরও।

বুয়েটের শিক্ষকরা ইতোমধ্যেই শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর কোন প্রভাব নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতি কার স্বার্থে সেই প্রশ্ন এখন নতুন করে উঠছে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও।

তানজিল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্রনেতাদের মতো শিক্ষকরাও প্রশাসনিক পদ-পদবি পাওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন বলে তার কাছে মনে হয়। তার মতে, শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের আসলে কোন কাজে আসে না। 'স্যারেরা তো এখন শিক্ষার্থীদের পক্ষে কোনো কথা বলেন না, শিক্ষার্থীদের পাশেও থাকেন না।'

বাংলাদেশে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। আর শিক্ষক প্রশাসনও নিয়ন্ত্রণে থাকে সরকারি দলের অনুগত শিক্ষকদের হাতে। গত প্রায় তিন দশক ধরেই ঘুরে ফিরে এ চিত্রই দেখা যাচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টরসহ সকল প্রশাসনিক পদ এক ধরনের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায় ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষকদের মধ্যে। এমনকি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেও অনেক ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, এখন দলভিত্তিক যে শিক্ষক রাজনীতি সেখানে আদর্শই মুখ্য নয়, বরং লোভের সংস্কৃতিটাই মুখ্য। তিনি বলছিলেন, '৮০'র দশকেও আমরা দেখেছে শিক্ষকদের মধ্যে আদর্শিক ভিন্নতা এবং ব্যবধান ছিল। কিন্তু সেই রাজনীতি তখন দলীয় রাজনীতি ছিলো না। সেটা ছিল গণমানুষের কল্যাণে, শিক্ষার কল্যাণে।'

'তারপর যেটি হলো, দেশে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো এলো এবং এসেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দখলের চেষ্টা করতে থাকলো। ছাত্রদেরকে প্রথমে দলে নেয়া হলো। ছাত্র সংগঠনগুলো হয়ে গেলো ঐ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের কর্মীদের একটা সম্মেলন। শিক্ষকদেরও সেভাবে নেয়া হলো।'

দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ যে আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং সেখানে বাংলাদেশের একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান হয়েছে। সেটাও ১ হাজারেরও বাইরে। যে ৫টি ক্যাটাগরিতে টাইমস হায়ার এডুকেশন নামে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং তৈরি করে সেখানে পাঠদান এবং গবেষণা -এই দুইটি ক্যাটাগরিতেই সবেচেয়ে কম স্কোর পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠদান ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাপ্ত স্কোর ১০০'র মধ্যে ১৬ আর গবেষণায় ৮ দশমিক ৮। অথচ পাঠদান ও গবেষণা এই দুটি অনেকাংশেই শিক্ষক নির্ভর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তার পেছনে শিক্ষক রাজনীতির একটা দায় আছে। তিনি বলছেন, 'শিক্ষকদের মৌলিক কাজ দুটি। পড়ানো এবং গবেষণা। এখন পড়াতে হলে তো আগে পড়তে হবে। শিক্ষকরা যদি অধ্যয়নের সময়টুকু রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন, কোথায় গেলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারবেন সেসবের জন্য তদবিরে ব্যস্ত থাকেন তখন স্বভাবত:ই তো প্রশ্ন আসে যে, তিনি পড়বেন কখন আর গবেষণাই বা করবেন কখন?'

তবে শুধু যে শিক্ষা এবং শিক্ষকের মানের কারণেই শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তা নয়। বরং সাম্প্রতিককালে দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা কারণেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশাসন বিতর্কের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের সমিতিগুলো থেকেও অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে শিক্ষকদের যেভাবে ন্যায়ের কথা বলা দরকার ছিল সেটা নেই। তিনি বলছেন, 'আমাদের এখানে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে সেগুলো যদি শিক্ষকরা সংঘবদ্ধভাবে দেখিয়ে দেন, যদি ছাত্রদের নিয়ে তারা সমাজের নানা অনাচার প্রতিহত করেন, শিক্ষানীতি নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে, এতগুলো পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার তো কোনো প্রতিবাদ দেখি না। সেখানে শিক্ষকদের ভূমিকা রাখার আছে। সেগুলো না করে যদি আমরা টেন্ডার ভাগাভাগিতে লিপ্ত হই আর আর ছাত্রলীগ-ছাত্রদল যদি আমাদের আর্দশ হয়, সেটা তো উচিত না। দেখা যাচ্ছে এখন ছাত্র নেতারাই শিক্ষকদের পরিচালিত করছে।'

কিন্তু শিক্ষক সংগঠনগুলো কেন দলীয় রাজনীতির বাইরে আসতে পারছে না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি'র সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল অবশ্য বলছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ ধারণ করা কোনো অপরাধ নয়। কোনো কোনো শিক্ষক হয়তো দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন, এরকম শিক্ষকদের কারণেই সবার উপর দোষ আসছে।

'আমরা হয়তো সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করি বা রাখি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই। যখন যে পর্যায়ে পরামর্শ বা প্রতিবাদ করা দরকার, আমরা সেটা করি। অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের চেয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোই বরং প্রয়োজনের সময় প্রতিবাদী ভূমিকায় থাকে।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063610076904297