বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের স্থান নেই

মাছুম বিল্লাহ |

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটানো হলো, ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, ঘটনার মদদদাতা, ঘটনার নিয়ন্ত্রক—সবাই মেধাবী! এ ধরনের মেধাবীদের দ্বারা সমাজ ও দেশ কী করবে? ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, ‘শুধু মেধাবী হলেই হয় না, শয়তানও মেধাবী, মেধার সঙ্গে মানবতা না থাকলে তা মানুষকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না।’ যে নিষ্ঠুরতা এই মেধাবীরা (?) প্রদর্শন করেছে, তার কোনো তুলনা নেই। কিভাবে একজন নিরীহ সহপাঠীকে তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি না করা সত্ত্বেও, তাদের স্বার্থে একবিন্দু পরিমাণ আঘাত না করা সত্ত্বেও নির্মমভাবে নির্যাতন করতে পারে, নির্যাতন করে মেরে ফেলতে পারে, তা কোনো সাধারণ মানুষেরও বুঝে আসে না। এসব মেধাবী যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কাজ শুরু করবে তখন  রডের পরিবর্তে বাঁশ কেন, কিছুই দেবে না, বরং উল্টো সব রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করবে। তা-ই করা হচ্ছে। কারণ শিক্ষাটা এই রকমই পাচ্ছে বা পেয়ে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, দলের নেতা কিংবা জাতি কারোরই কি কোনো দায়িত্ব নেই? আবরার যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, ওদের কাছে তখন পানি চেয়েছিল, ওরা পানি তো দেয়ইনি বরং বলেছে, ‘ও নাটক করছে।’ কেউ একজন পানি দিতে চাইলে বাকিরা বলেছে, ‘ওকে পানি দিস না, ও নাটক করছে, ওকে আরো ঘণ্টাদুয়েক পেটানো যাবে।’ এভাবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে দানবদের আড্ডাখানা বানানো হয়েছে। এ জন্য কে বা কারা দায়ী? কেউ কি দায় এড়াতে পারে? সব বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘টর্চার সেল’ বানানো হয়েছে। পুরো দেশে টর্চার সেল। মিডিয়ার কল্যাণে কিছুমাত্র প্রকাশ হয়েছে। এই কি আমার দেশ? এ জন্যই কি এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল, এ জন্যই কি দুই লাখ মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন? দেশ কার কাছে এর জবাব চাইবে? বহুবার বহুদিন বিভিন্ন মিডিয়া বিভিন্নভাবে প্রচার করার চেষ্টা করেছে, কেউ কেউ অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে প্রচারও করেছে যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক টর্চার করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের খবর, গণরুমে কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়, গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে কিভাবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়, কিভাবে মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে টর্চার করা হয়—এ নিয়ে বহুবার লেখালেখি হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিকার করার চেষ্টা করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রশাসনের হয়তো অনেক কষ্ট হতো, তার পরও কিভাবে আপনারা ছেড়ে দেন তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে হলের সিট বণ্টন, হলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার? আপনারা কি আসলেই দায় এড়াতে পারেন? আপনারা তো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেন। সেটি তো আপনাদের আদায় করে নিতে হবে।

যারা আজ এমন নিষ্ঠুরতা করেছে তারা তো এ রকম ছিল না। তারা তো বই-পুস্তক পড়ে, বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে ভর্তি হয়েছিল। পত্রিকায় দেখলাম, এ দানবদের সবার বাড়িই গ্রামে। সবাই মোটামুটি সাধারণ পরিবারের সন্তান। দেখলাম, তারা কেউই জি কে শামীম, খালেদ বা ক্যাসিনো সাম্রাজ্য থেকে অসেনি। ওই রকম পরিবার থেকে এসে থাকলে এত অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। যারা বা যে পরিবেশ তাদের এ রকম সাক্ষাৎ জল্লাদ বানাল, এ রকম বড়মাপের ডাকাত বানাল তারা কারা? জাতি কি এই দায় এড়াতে পারে? এমন নৃশংসতা তো পেশাদার খুনিদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। তাহলে তারা কেন এমন হলো? পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে চলতে থাকা নীতিহীনতা তাদের এসব ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড উৎসাহ জুগিয়েছে। আমরা কি তা অস্বীকার করতে পারি? তারা বিশ্বাস করে, তাদের কিছুই হবে না। টিভির পর্দায় কিংবা পত্রিকার পাতায় দেখা যাচ্ছে খুনিদের যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা হাসছে। সমাজের এই চরম অবক্ষয়, পশুত্ব ও নির্মমতার জোর ওই নষ্ট রাজনীতিতে। তাদের মানবতা নেই, মনুষ্যত্ব নেই, সহমর্মিতা নেই, আছে ওই নষ্ট রাজনীতির জোর। সেই ছাত্ররাজনীতি কি দেশের প্রকৃত কল্যাণের জন্য কিছু করতে পারে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী দেখলে, শিক্ষার্থীর কথা মনে হলে মানুষের মাথা নত হওয়ার কথা, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে ও ভালোবাসায়। সেই জায়গায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই, বিশেষ করে ছাত্রনেতার নাম শুনলেই মানুষের গা শিউরে ওঠে, মানুষের মনের কোণে অজান্তে ঘৃণা জমে ওঠে। তাদের এতটুকু বিকার নেই। জাফর ইকবাল স্যার তাঁর ‘দানবের জন্ম’ লেখায় বলেছেন, ‘আমি ঠিক জানি না, আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা জানেন কি না, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রলীগের ওপর কতটুকু ক্ষুব্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতো আমার কোনো রকম হেনস্তা সহ্য করতে হয় না; কিন্তু তার পরও আমি যেকোনো সময় চোখ বন্ধ করে তাদের বিশাল অপকর্মের লিস্ট তুলে ধরতে পারব। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এ ক্ষোভ ঘৃণার পর্যায়ে চলে গেছে এবং দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের যে কয়টি আন্দোলন হয়েছে তার সবাই আসলে ছাত্রলীগের প্রতি ভয়ংকর ক্ষোভের এক ধরনের প্রতিক্রিয়া।’

বুয়েট কর্তৃপক্ষ অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল যে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে কী হবে? সেখানে তাহলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য এই বাহিনী রেখে দেব! কী লাভ? কী দেয় এরা পার্টিকে? কী দেয় এরা দেশকে? কী দেয় এরা জাতিকে? কেন তাদের পুষতে হবে? এসব আমাদের বুঝে আসে না। পার্টির হয়তো এতটুকু লাভ হয়েছে যে কিছু নেতার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ও অর্থ কেলেঙ্কারির যে খবর মিডিয়ায় বড় করে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, সেটাতে কিছুটা ভাটা পড়বে। কিন্তু তাতে আর কতটুকু লাভ? আর সেই লাভই বা কয় দিন? অবশ্য জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল তাদের জানা আছে। সেই কৌশলের কাছে হার মানবে এরূপ ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ যথার্থই বলেছেন, ‘বিএনপি, জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগ সব আমলেই ছাত্ররাজনীতির ক্ষমতাবানদের চেহারা একই ছিল। নিয়ন্ত্রকদের আচরণও ভিন্ন কিছু ছিল না। নিজ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের সুস্থ পথে চলার দিকনির্দেশনা কি তাঁরা কখনো দিয়েছেন? এই যে সরকারের শুদ্ধি অভিযান চলছে, বড় বড় যুবলীগ নেতা ধরা পড়ছেন, এতে তো কিছুমাত্র বিচলিত নন ছাত্রলীগ নেতারা। তাঁরা হাসতে হাসতে সতীর্থদের খুন করে ফেলছেন। জানেন বরাবরের মতোই তাঁরা আশ্রয়দাতা পেয়ে যাবেন।’

আমরা আসলেই যদি চাই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো প্রকৃত শিক্ষালয়ে পরিণত করব, তাহলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ভর্তির পদ্ধতিও বদলাতে হবে। শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান যাচাই করলেই হবে না, শুধু টিক দিলেই হবে না। পরীক্ষাপদ্ধতিতে এমন কিছু লিখতে দিতে হবে, এমন কিছু মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষা থাকতে হবে, যেগুলো প্রমাণ করে যে এই শিক্ষার্থী কতটা মানবিক, কতটা দেশপ্রেম তার মনের কোণে লুকিয়ে আছে, সে কতটা নিষ্ঠুর, কতটা অমানবিক, ক্ষমতাবান হলে সে কিরূপ আচরণ করবে, সেগুলো যাতে পরীক্ষার মাধ্যমে বের হয়ে আসে। ভর্তির সময় তার কিছু শপথ লেখা থাকতে হবে, যাতে সে লিখবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কাজ সে করবে না, কোনো ধরনের অমানবিক কাজ সে করবে না। রাজনীতিতে যুক্ত হলেও যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ করবে না, করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে যেকোনো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গন থেকে বের করে দিতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই ভোগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জল্লাদের উল্লাসমঞ্চই হতে থাকবে।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061359405517578