বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোলে তৈরি হয় নিপীড়ক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে চিন্তার নতুন দরোজা খুলে দিতে পারে। নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বেদনাদায়ক এ হত্যার পর প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ রকম খুনি-নিপীড়ক তৈরি হয়? বিশেষ করে বুয়েটের মতো বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন, দেশ-বিদেশে যে প্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের বিপুল স্বীকৃতি, সেখানে কীভাবে এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড হতে পারে? এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে একাধিক ‘টর্চার সেল’ থাকতে পারে? কেমন করে দীর্ঘদিন যাবৎ টিকে আছে এ ধরনের নিপীড়ন-সহায়ক প্রতিষ্ঠান? সহপাঠী ও সিনিয়র শিক্ষার্থী, যাঁরা আবরারের মতোই মানুষরূপী, কীভাবে তাঁরা এতটা অমানবিক হতে পারেন? একজন শিক্ষার্থীকে সামান্য একটি ফেসবুক মন্তব্যের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিপীড়ন করে হত্যা করতে পারেন! মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুগের বেশি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতার জোরে আমি বলতে পারি যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো একেকটি নিপীড়ক গড়ার কারখানা। রাজনৈতিক দলের কাছে অতি-আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া এবং নিজেদের গদি পাকাপোক্ত করতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যে ইঁদুরদৌড় প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, তা এ ধরনের নিপীড়ক তৈরির মূল কারণ। এখানে বলা প্রয়োজন যে আবরার হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নের চরিত্র তুলে ধরে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শুধু রাজনৈতিক নিপীড়ন নয়, সন্ত্রাস ও অপরাধের অভয়ারণ্য নয় শুধু, এখানে যৌন নিপীড়নসহ আরও নানা ধরনের নিপীড়ক গড়ে ওঠে মূলত প্রশাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। এটা কীভাবে হয়, তা বিশ্লেষণ করার আগে আমাদের জানা দরকার শিক্ষার্থীরা, যাঁরা পড়তে আসেন, তাঁরা আসলে কতটা সন্ত্রাসী হয়ে আসেন এবং কতটা মানুষ হিসেবে আসেন।

প্রতিবছর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন, শুরুতে তাঁরা একেবারেই নিষ্পাপ থাকেন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই শুরুতে প্রচণ্ড রাজনীতিবিমুখ থাকেন। সবারই স্বপ্ন থাকে শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ব্যক্তি ও পরিবারের সব সদস্যকে গৌরবান্বিত করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের সামনে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে দেয় যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রচণ্ড নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীও নিপীড়ক হয়ে ওঠেন। সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউই খুনি হিসেবে বুয়েটে ভর্তি হননি, এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁরা প্রত্যেকেই আজ খুনি।

কেমন করে তৈরি হয় এসব খুনি? এটা বুঝতে হলে একটু বুয়েটের হত্যাকাণ্ডের দিকে নজর দিতে হবে। আবরার খুন হওয়ার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য মহোদয় শিক্ষার্থীদের সামনে আসেননি। নিজের নিহত শিক্ষার্থীকে একনজর দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি তিনি। উপাচার্য স্বীকার করেছেন, এ সময় তিনি মন্ত্রী ও অন্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। অন্যদিকে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে দীর্ঘ সময় আবরারের লাশের সামনে হলের প্রভোস্ট খুনিদের সঙ্গে নির্লিপ্ত আলাপচারিতায় ছিলেন। পুলিশ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল হলের বাইরে। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানা যায়, সেখানে মাদক রাখার দায়ে একটি গণপিটুনির নাটক করার চেষ্টাও করা হয়েছিল। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, খুনিদের রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন উপাচার্য এবং প্রশাসনের অন্য কর্তারা। এটা ছিল এ পর্যায়ের শেষ চেষ্টা। এ রকম অনেক চেষ্টা, আর ঘটনার আড়াল হলগুলোতে টর্চার সেল বানাতে ও টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়েছিল।

শুধু বুয়েটের সিএসই বিভাগের তৈরি করা ওয়েবপেজে গত আড়াই বছরের শিক্ষার্থীরা ১০৩টি অভিযোগ করেছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে বিআরটিএ ইতিমধ্যে তা বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হলেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমন ঘটনা কেবল বুয়েটেই সীমাবদ্ধ নয়, কমবেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ রকম নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বিচার চেয়ে কোনো প্রতিকার পান না।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক আবাসিক হল থাকে, যাতে প্রভোস্ট পদে একজন শিক্ষক থাকেন। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন শিক্ষক ওয়ার্ডেন, আবাসিক শিক্ষক, সহ-আবাসিক শিক্ষক হিসেবে থাকেন। সব মিলিয়ে ১০-১৫ জনের একটি টিম থাকে। টিমের প্রায় সবাই সাধারণত সরকারি দলের অনুগত শিক্ষক হয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট ইত্যাদি পদগুলোকে শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘অর্থকরী পদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা ভাইস চ্যান্সেলর তাঁর নিজের ক্ষমতাবলে বিতরণ করেন। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, আর্থিক-জাগতিক লোভ-লালসা থাকে। তাঁদের দায়িত্ব ছিল হল প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধান, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার দেখভাল করা। কিন্তু কার্যত তাঁরা হল প্রশাসনের সব দায়িত্ব ছাত্রসংগঠনের হল কমিটির নেতা-কর্মীদের ওপর ছেড়ে দেন। এর মাধ্যমে তাঁরা মূলত ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন, যা তাঁদের আরও উচ্চ পদ লাভে সহায়ক হয়। আর্থিক ও পদলোভী ‘আত্মসম্মানহীন শিক্ষকেরা’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষায়, ‘দেখতে দেখতে কেঁচোর মতো হয়ে যান।’ ফলে তাঁদের কাছে ভোটের আগে ব্যালট ভর্তি করা যেমন কোনো ব্যাপার নয়, তেমনি ছাত্রদের বাঁচানোর কোনো দায়ও থাকে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা থেকে বাঁচতে অসহায় শিক্ষার্থীরা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু এতে তাঁদের ঝামেলা বাড়ে, কমে না। জগতে সবার মনের জোর যেমন এক নয়, তেমনি সবার নৈতিক জোরও এক রকম নয়। ফলে, অনেক শিক্ষার্থীই গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন। মাস্তান হিসেবে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেন। তাঁরা জানেন যে কোনো অপকর্ম করলে তাঁদের বাঁচানোর জন্য প্রশাসন সবকিছু করবে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে কেউ কেউ প্রথমে নিপীড়ক হন, তারপর মানসিকভাবে খুনি হন। ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রশাসন চেষ্টা করেছে খুনিদের বাঁচাতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর প্রথমবারের মতো একটি খুনের (যুবায়ের হত্যা) বিচার সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বিচারের পর দেখা গেল দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিরা আমাদের নিয়ে তামাশা করে বিদেশ থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন: ‘আমি পাখির মতো মুক্ত...এখন আমি উড়তে পারি...!’ খুনিদের এই উড়তে পারা নতুন নতুন খুনি তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া এঁরা কখনোই উড়তে পারতেন না। আর এঁদের ডানা কাটা থাকলে আজ আবরারকে মরতে হতো না।

মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050599575042725