বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৮ ধরনের করোনা ভাইরাস

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ভাইরাসের স্বরূপ বুঝতে ৩৫টি দেশ মিলে হাজারের বেশি জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছে করোনার। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মানুষকে আক্রান্ত করা ভাইরাসটির আট ধরনের খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বারবার বৈশিষ্ট্য বদল করা এ ভাইরাসের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করছেন সবাই। ভারতও পরিবর্তন পেয়েছে তাদের দেশে আক্রমণ করা করোনা ভাইরাসের। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর স্বরূপ জানা যায়নি। শনিবার (৪ এপ্রিল) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মহিউদ্দিন।

প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুসারে আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮৯ জনের বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসে বা কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৫৮ হাজার ৯০১ জনের । এ মহামারি প্রতিরোধে করোনা ভাইরাসটির স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়ে। চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে উন্মোচিত ভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ভাইরাসের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে পড়েছে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝখানে ভাইরাসটির আক্রমণের শক্তিমত্তা বেড়ে যাওয়ার খেসারত দিচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। চীন থেকে ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসেছে করোনা ভাইরাস। তবে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভাইরাসটির শক্তি বাড়া বা কমার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের অন্য একটি পক্ষ বলছে, জিনগত পরিবর্তন খুব সামান্য। আক্রান্ত বাড়ার ক্ষেত্রে আবহাওয়া একটা নিয়ামক হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি ভাইরাসের ভেতরে ডিএনএ ও আরএনএর মতো বংশীয় নিউক্লিওটাইড থাকে, যা কিনা একটি প্রোটিনের আবরণে মোড়া। এর মধ্যে কিছু প্রোটিন স্পাইক বা গজালের মতো ভাইরাসের দেহ থেকে বের হয়ে থাকে। করোনা ভাইরাসের ভেতরে রয়েছে একটা আরএনএ ফিতা। আর বাইরে এস-প্রোটিন নামে একটি গজাল বা স্পাইক রয়েছে। এ ধরনের আরএনএ ভাইরাস সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল বাশার মীর মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলাম বলেন, ভাইরাসটির জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের হার এখন কমে এসেছে। এতে আক্রমণের ক্ষমতাও কমতে পারে। এ কারণেই হয়তো ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে তেমন আক্রান্তের ঘটনা ঘটেনি।

মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলাম মনে করছেন, বাংলাদেশে আসার পর পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা ভাইরাসটির জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের পর জানা যাবে। মাঝখানে ভাইরাসটি খুব বেশি পরিবর্তিত হচ্ছিল, যে কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়।

২ এপ্রিল পর্যন্ত জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, করোনা আক্রান্তের ৭৮ শতাংশ রোগী ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার। আর এ দুই অঞ্চলে অধিকাংশই আক্রান্ত হয়েছে মার্চ মাসে। পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তারা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। যদিও ভাইরাসটি গত জানুয়ারি থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একই সময়ে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় আছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ অঞ্চলের ৮টি দেশে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৫৮৪ জন।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সী বলেন, জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির আটটি ধরন বা প্রজাতি পাওয়া গেছে। আর ভাইরাসের নিউক্লিওটাইডে ১১টি পরিবর্তন দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব পরিবর্তনে উল্লেখ করার মতো পার্থক্য পাওয়া যায়নি। তাই অন্তত জিনগত বৈশিষ্ট্যের জন্য আলাদা অঞ্চলে আলাদা প্রভাব পড়ার কথা নয়।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করায় ভাইরাসটির জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের সুযোগ পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। আন্তর্জাতিক দুটি ল্যাবরেটরি আইইডিসিআরের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এ ধরনের নমুনা পাঠাতে দুনিয়াজুড়ে বিশ্বস্ত হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড কুরিয়ার’। লকডাউনের কারণে তারা নমুনা নিতে পারছে না। যদিও ভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের সক্ষমতা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির। করোনা উপসর্গ থাকা ব্যক্তিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাপ সামলাতে গিয়ে সময় পাচ্ছেন না সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটির পুনরুৎপাদনের হার চারের কাছাকাছি। এটি দুইয়ে নেমে এলেও আক্রান্ত হওয়ার হার তেমন কমানো যাবে না। এটিতে একে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়ে। প্রতিষেধক আবিষ্কারেরও চেষ্টা করছে একাধিক দেশ। আপাতত পুরোপুরি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ কমানোটাই মূল কৌশল। এখন পর্যন্ত এর কোনো বিকল্প নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা বিস্তারের গতি-প্রকৃতি আশা জাগাচ্ছে।

এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, ইতিমধ্যে ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের জন্য শিগগিরই এটি আন্তর্জাতিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হবে। এটি একেবারেই নতুন ধরনের ভাইরাস, প্রতিনিয়ত গতি–প্রকৃতি বদলাচ্ছে। তাই দেশে এর বিস্তার বাড়া বা কমা সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে যত করোনাভাইরাস দেখা গেছে, সবগুলোর মধ্যেই ঋতুভিত্তিক একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সার্স, মার্স, সোয়াইন ফ্লু—সবকিছুতেই ঋতুর একটি প্রভাব ছিল। নতুন করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি মানুষের শ্বাসনালিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কোষকে দখলে নিয়ে নিজের আরও লাখ লাখ সংস্করণ তৈরি করে ফেলে। আর উপসর্গ প্রকাশিত হওয়ার আগেই সে আরও মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলে। ইতালিতে এ ভাইরাসের আরএনএতে তিনটি নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে এটি মানুষের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে পড়েছে। তবে ভারতে উন্মোচিত জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে আশাবাদী হয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলে ইউরোপের মতো ক্ষতি না–ও হতে পারে।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণা বলছে, আক্রান্ত দেশগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৪ থেকে ৯ গ্রাম। আর এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম আছে, সেখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো কম হবে। কারণ, এই অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০ গ্রাম পর্যন্ত।

জানা গেছে, চীনের পরপরই তাদের প্রতিবেশী হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তিনটি দেশই করোনার ব্যাপক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগের হাব হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুর। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৯ জন, যার মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন। এতে আশাবাদী হয়ে তাঁরা বলছেন, চীন থেকে ইউরোপ ঘুরে ভাইরাসটি দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে। এর মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের কারণে এটি দুর্বল হয়েছে। এ অঞ্চলের উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কাজ করেছে করোনার বিস্তারের প্রতিকূলে।

ভারতের পদ্মভূষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক জি পি নাগেশ্বর রেড্ডি সে দেশের গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, চীন ও ভারতে ভাইরাসটির জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা হয়েছে। ইতালিতে ছড়ানো ভাইরাসের সঙ্গে ভারতে ছড়ানো ভাইরাসের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভারতের ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062549114227295