সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রমহারা নারীদের খেতাব দিয়েছেন 'বীরাঙ্গনা' মানে সাহসী নারী। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিতা বীরাঙ্গনা মোসা. ববিজান বেওয়া অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন। তার বাড়ি মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের বাঁশতৈল পশ্চিমপাড়া গ্রামে। পিতার নাম মৃত আরাদন আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬, ২১, ২৯ ডিসেম্বর ও ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে জামুকার ৬২তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৯ জুলাই জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২ এর ৭(ঝ) ধারা অনুযায়ী সারাদেশে ৪৬ জনের বীরাঙ্গনার নামে প্রজ্ঞাপন জারি করে। যা গত ২৯ জুলাই গেজেট প্রকাশ করা হয়।
জানা গেছে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে একই গ্রামের দবু খাঁর ছেলে দুদু খাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় ববিজানের। সাত বছরের সংসারজীবন চলাকালে শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ। তাদের গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনা। ১৯ বছরের সুন্দরী যুবতী বাংলার সহজ-সরল গৃহবধূ ববিজানের ওপর নজর পড়ে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের। সে দিনের সেই ভয়াবহতার কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন ববিজান বেওয়া।
বৃদ্ধা ববিজান বেওয়া জানান, যুদ্ধ চলাকালে একদিন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের বাঁশতৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিএসসি ও আরও কয়েকজনের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ওই দিনই পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ববিজানসহ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে। অস্ত্রের ভয় আর গণধর্ষণের কারণে জ্ঞান হারান তিনি। গণধর্ষণ শেষে পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে আশপাশের বাড়ির লোকজন উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন তাকেসহ অন্য ধর্ষিতাদের। কিন্তু সুস্থ হলেও ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে স্বামীর সংসার ছাড়তে হয় তাকে।
সাত বছরের সংসারজীবন থেকে এক বছরের শিশুকন্যা রহিমাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন ববিজান। ঘরে সৎ মা থাকায় বাবার অভাবের সংসারে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি ববিজান এবং তার শিশু মেয়ের।
যুদ্ধের কিছুদিন পর ময়মনসিংহের আব্দুল মালেক নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় ববিজানের। কিন্তু আগে থেকে তার স্ত্রী-সন্তান থাকায় সেখানে বেশিদিন সংসার করতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে জন্ম হওয়া ছেলে রফিকুলকে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়ি বাঁশতৈল গ্রামে।
তার বাবার মৃত্যুতে সৎ মায়ের সংসারে জায়গা না হওয়ায় সরকারি জমিতে ঘর তুলে মেয়ে রহিমা ও ছেলে রফিকুলকে নিয়ে সেখানে কোনো রকম বসবাস শুরু করেন। শিশু ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভিক্ষা করে খেয়ে না-খেয়ে চলতে থাকে ববিজানের সংসার।
তার এই দুরবস্থা দেখে বাঁশতৈল গ্রামের বৃদ্ধ ইয়াদ আলী তার সেবাযত্ন করার জন্য তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। ১০ বছর আগে ইয়াদ আলী মারা গেলে ছেলে রফিকুলের সঙ্গে বন বিভাগের জায়গায় বসবাস করতে থাকেন।
২৩ বছর আগে বন বিভাগের একটি প্লট পান ববিজান বেওয়া। কিন্তু সেই প্লট নিয়েও বাঁশতৈল গ্রামের গফুর মিয়ার ছেলে নুরু মিয়া নানাভাবে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন ববিজান। অথচ নুরু মিয়ার নামে বন বিভাগের তিনটি প্লট রয়েছে বলে জানান ববিজান।
বয়স হওয়ায় এখন কানেও কম শোনেন, স্মৃতিশক্তিও কমে গেছে। ববিজানের দুঃখ, যুদ্ধের পর সমাজ তো তাদের মেনেই নেয়নি, উল্টো খারাপ কথা ও কটূক্তি শুনতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও কষ্ট গেল না তার। এ কথা বলে কেঁদে ফেলেন ববিজান। কাজকার্ম করতে না পারায় ছেলের সংসারে খেয়ে না-খেয়ে কাটছে বীরাঙ্গনা বৃদ্ধা ববিজানের দিন। ববিজান বলেন, কেউ তো কোনো দিন আমার খবরও নেয় না- এ কথা কারও কাছে বলতেও ভালো লাগে না।
সরকারি কোনো সুবিধা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের লাঞ্ছনা, ঘৃণা, অপবাদ আর ঘাড়ধাক্কা পেয়েছি। গত দুই বছর আগে সাংবাদিকরা আমাকে নিয়ে খবর ছাপানোর পর বয়স্ক ভাতার কার্ড ও ঢেউটিন পেয়েছি। তা ছাড়া বন বিভাগের একটি প্লট ছাড়া সরকারি কোনো সযোগ-সুবিধাও পাননি বলে জানান।
বীরাঙ্গনা ববিজান বেওয়া বলেন, স্বাধীনতার পর কেউ আমাকে নিয়ে চিন্তা করেননি। সাংবাদিকরা লেখার পর সরকার আমার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দিয়েছেন বলে শুনেছি। এ জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাংবাদিকদের প্রাণভরে দোয়া করেছি।
বাঁশতৈল ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইয়াকুব আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, যেদিন পাকিস্তানি সেনারা বাঁশতৈল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিএসসির বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, একই দিন দুদু খাঁর বাড়িতে ঢুকে ববিজানসহ গ্রামের কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। ওই ঘটনার পর দুদু খাঁ ববিজানকে ত্যাগ করেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হলে ববিজানের নাম বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।
মির্জাপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. খায়রুল ইসলাম ববিজানের নামের গেজেট পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সরকারি সকল সুবিধা দেয়ার জন্য তার অফিস কাজ করছেন বলে জানান।