বুয়েটে কমিটি ভাঙতে নারাজ ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আর বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দা-কুমড়া সম্পর্ক। পারস্পরিক সংঘাতের বিভিন্ন ঘটনায় এ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একই বিন্দুতে অবস্থান নিয়েছে তারা। উভয়েরই আশঙ্কা, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে বুয়েটে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ‘অন্ধকারের শক্তিরাশি’।  মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের বাইরে বুয়েট ক্যাম্পাসে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের শাখা কমিটি নেই। তবে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বুয়েটে শুধু ছাত্রলীগের কার্যক্রম দৃশ্যমান।

ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তাঁরা মানেন না। তাই নিজেদের বুয়েট শাখা কমিটিও তাঁরা ভাঙবেন না। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে সেখানে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সংগঠনগুলো সুযোগ নেবে। এর ফলে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা সেখানে হুমকির মুখে পড়বে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলছেন, বুয়েটে যে সংকট তৈরি হয়েছে, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার মধ্যে তার কোনো সমাধান নেই। ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলোকে বিদায় করার দাবি উঠতে পারে, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। নাহিয়ান বলেন, ‘সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিগগিরই বুয়েট প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হবে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে সেখানে অন্ধকারের শক্তি, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর গোপন তৎপরতার শক্তিবৃদ্ধি হবে, যা দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।’

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনেরও আশঙ্কা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে বুয়েটে ‘অস্বাভাবিক’ রাজনীতির বিস্তার ঘটবে। এই বিষয়টিতে ছাত্রলীগের সঙ্গে একাত্মতা জানালেন ইকবাল। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত বুয়েট কর্তৃপক্ষ নিয়েছে, তা আমরা মানি না। বুয়েটে আমাদের যে কমিটি রয়েছে, তা ভাঙা বা বিলুপ্ত করার প্রশ্নই আসে না। কমিটি তখনই ভাঙা হবে, যখন নতুন কমিটি দেয়া হবে।’

বুয়েটের অধ্যাদেশ সংস্কারের দাবি

যে অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েট পরিচালিত হয়, তার ১৬ ধারা অনুযায়ী বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। ‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অরডিন্যান্স’ নামক ওই আইনটি ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয়, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক আইয়ুব খান।

ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলছেন, এই আইন তাঁরা মানেন না। তিনি বলেন, ‘বুয়েট যে আইনে পরিচালিত হয়, তা স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের প্রণীত আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন চলতে পারে না। এই আইন সংস্কার করতে হবে, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসংক্রান্ত ধারা বাতিল করে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ তৈরি করতে হবে।’

ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খানও বুয়েটের অধ্যাদেশের ওই ধারা সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। দেশ ও জাতির সংকটে ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে, ছাত্রদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থেকেছে। তাই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়।’

ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বুয়েটের অধ্যাদেশে ছাত্ররাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত ধারা বাতিল ও সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি চলছে।

সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। আইয়ুব খানের সময়ে প্রণীত বুয়েটের অধ্যাদেশকে ‘পাকিস্তানি অধ্যাদেশ’ আখ্যা দিয়ে এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বুয়েট পরিচালনার জন্য নতুন অধ্যাদেশ প্রণয়নের দাবিও জানান সংগঠনটির নেতারা। এ ছাড়াও প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার ‘অপরাধে’ ও দায়িত্ব পালনে ‘ব্যর্থতার’ দায় নিয়ে বুয়েটের উপাচার্যকে অপসারণের দাবি জানায় সংগঠনটি।

বুয়েটের অধ্যাদেশের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, ডিরেক্টর অব স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ারের (ডিএসডব্লিউ) লিখিত অনুমোদন ছাড়া বুয়েট ক্যাম্পাসে কোনো ক্লাব বা সোসাইটি বা ছাত্রসংগঠন (বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, ডিপার্টমেন্ট বা হল অ্যাসোসিয়েশন ব্যতিরেকে) গঠন করা যাবে না। ডিএসডব্লিউর পূর্বানুমোদন ছাড়া বুয়েট চত্বরে শিক্ষার্থীরা কোনো সভা, পার্টি বা বিনোদনের আয়োজন করতে পারবেন না কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারবেন না।

অধ্যাদেশের অধীনে ‘অরডিন্যান্স রিলেটিং টু দ্য বোর্ড অব রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন’ নামে একটি বোর্ডও গঠন করা হয়। অননুমোদিত ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব এই বোর্ডের। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জুলাই বুয়েটের একাডেমিক কাউন্সিল অধ্যাদেশটিতে সর্বশেষ সংশোধনী এনেছিল।

২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুন বুয়েটে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হন কেমিকৌশল বিভাগের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। এরপর ২০ জুলাই একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অধ্যাদেশের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসংক্রান্ত ধারাটি বাস্তবে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। সেদিন থেকে ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ বা কর্মসূচি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।

২০০২ খ্রিষ্টাব্দে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে ঘোষিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে বুয়েট শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে বা তার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। এই শৃঙ্খলাবিধি তাঁদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এটি অমান্য করলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে ফের প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়।

গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ইতোমধ্যে সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়নও শুরু করেছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামী উস সানী ও সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মেহেদী হাসান ওরফে রাসেলের হলের কক্ষ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে, সিলগালা করা হয়েছে ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হলের একটি কক্ষও।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006004810333252