বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজ ও মাদরাসায় কর্মরত প্রভাষকরা চরম বৈষম্যের শিকার। সরকারি কলেজের প্রভাষক যে যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন বেসরকারি প্রভাষকরা সমান যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন। সরকারি কলেজের প্রভাষকরা যে সিলেবাসে পাঠদান করেন বেসরকারি প্রভাষকরা ঐ সিলেবাসেই পাঠদান করেন।
এনটিআরসিএর মাধ্যমে বেসরকারি প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সব প্রকার কোটামুক্ত, তদবির এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। অন্যদিকে সরকারি প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরিভাবে কোটা, তদবির ও রাজনৈতিক প্রভাবের কুলুষমুক্ত নয়।
একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক চাকরিতে প্রবেশের পর অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে বেতন একধাপ এগিয়ে থাকেন। নিয়মিত বদলি হতে পারেন। বাড়ীভাড়া, উৎসবভাতা, চিকিৎসা ভাতা ,সন্তানের শিক্ষা ভাতাসহ অনেক ধরনের আর্থিক সুবিধা পান। দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহনের মাধ্যমে পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পান। তাদের ওপর অশিক্ষিত কমিটি ও অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা নেই। প্রথমে প্রভাষক পদে চাকরিতে প্রবেশের পর পর্যায়ক্রমে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক সর্বশেষে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে মর্যাদা সম্পন্ন হতে পারেন। চাকরি শেষে নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে মাসিক পেনশন ও এককালীন ব্যাপক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে বেসরকারি প্রভাষকরা কাম্য যোগ্যতার অতিরিক্ত যত যোগ্যতাই থাকুক কোন প্রকার সুবিধা পান না। সারাজীবনে বদলি কল্পনা করতে পারেন না। এক হাজার টাকা দিয়ে বাড়ী ভাড়া পাওয়া যায় না। শুনেছি এখনকার সময় রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে রাতে ঘুমাতে ও নাকি একহাজার টাকার বেশি লাগে। উৎসব ভাতা সিকিভাগ। এর মানে হলো বেসরকারি শিক্ষকদের উৎসব সিকিভাগ পালন করতে হবে। চিকিৎসা ভাতা পাঁচশত টাকা যা দিয়ে একজন ডাক্তারের একবারের ফি দেয়া সম্ভব হয় না। অনান্য কোন ভাতা সম্পর্কে জানারই সুযোগই হয় না। দেশি বেদেশি কোন প্রকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রভাষকদের জন্য নেই। পদোন্নতি নামক সোনার হরিণ অনুপাত প্রথা( ৫:২) নামক লটারিতে সীমাবদ্ধ। শতকরা দুই চারভাগ প্রভাষক যাদের নাম উঠে তারা ছাড়া বাকী সবাইকে সারাজীবন প্রভাষকই থাকতে হয়।
অশিক্ষিত ম্যনেজিং কমিটি ও অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ স্বৈরাচারী অধ্যক্ষদের নির্যাতনে পিষ্ট প্রভাষকদের সারাদিন কাটে মনোকষ্টে। সারাজীবন কষ্টে করে অপরের সন্তান মানুষ করে সরকারি দায়িত্ব পালন করে চাকুরী শেষে না খেয়ে চিকিৎসার অভাবে একপ্রকার দুঃখ কষ্টে জীবন প্রদীপ নিভে যায়। নিজেদের বেতন থেকে কেটে রেখে অবসর ভাতা হিসেবে যে ভিক্ষার মত এককালীন কিছু টাকা পাওয়ার কথা সেটা মৃত্যুর অনেক পরে পাওয়া যায়।
চাকরি শেষে একপ্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয়। এভাবেই বেসরকারি প্রভাষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এখানে তুলনামুলক কিছু চিত্র তুলে ধরলাম। এবার কিছু বাস্তবতা নিয়ে বলি।
একজন প্রভাষক দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাব-মার কষ্টের টাকায় পড়ালেখা করে জাতিগঠনের মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন। প্রথমেই তিনি যে বেতন পান তা দিয়ে বাবা-মার জন্য কিছুই করতে পারেন না। না পারেন তাদের চিকিৎসা করাতে। না পারেন ভালো মানের জীবন যাপনে অর্থনৈতিক সহযোগীতা করতে। ফলস্বরূপ নিজেরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যে বেতন পায় তা বাসা ভাড়াও যাতায়াতেই শেষ সুন্দর জীবন সূদূর পরাহত। কিছুদিন পর বিয়ে করে সন্তান হলে স্ত্রী সন্তান ও বৃদ্ধা বাব-মাসহ এক দূর্বীসহ জীবন যাপন করতে হয়। সন্তানের পিছনে ভালো খরচ করতে না পারার কারণে স্ত্রীর দেয়া মানসিক যন্ত্রনা নিয়মিত ঘটনা।
একজন বেসরকারি প্রভাষক এতসব কষ্টের মধ্যে থেকে কিভাবে মনোযোগ দিয়ে আপনাদের সন্তানকে সর্বোচ্চ শিক্ষাদান করবে? কিভাবে এত ধরনের বৈষম্যকে মানিয় নিবে। এই সমস্ত অমানবিক নির্যাতনমূলক বৈষম্যগুলো মুছে দিতে হবে। তাহলেই হবে ন্যায় বিচার। একজন প্রভাষক যখন তার ন্যায্য অধিকার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবেন, তখন তার কাছ থেকে সেরাটা আশা করা চরম বোকামী এবং প্রতারণামূলক হবে। আশা করি কতৃপক্ষ বিষয়টি গভীর মনোযোগে সাথে দেখবেন এবং কার্যকর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
লেখক : সাইফুল ইসলাম খান, প্রভাষক, চাঁদপুর