বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি : আবেগ নয় যুক্তি চাই

মো. রহমত উল্লাহ্ |

নিয়োজিত কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই বদলি ব্যবস্থা বিদ্যমান। এই বিধানের আওতায় একই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এক স্থান/অফিস থেকে অন্য স্থানে/অফিসে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বদলি হয়ে থাকেন। এই বদলি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের থাকে অনেক কাজ, কর্মীদের থাকে অনেক সন্তোষ/অসন্তোষ, থাকে অনেক তদবির এবং আরও অনেক অনেক না বলা কথা। তথাপি বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান বদলি ব্যবস্থা। কেননা, নিজের সুবিধাজনক স্থানে বদলির সুযোগ পাওয়া কর্মীর অধিকার এবং প্রতিষ্ঠানের সুবিধার্থে কর্মীকে বদলি করা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন।

নিজেদের তাগিদেই বদলির সুযোগ দেয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন বেশ কিছু এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক। এই দাবিতে তারা আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন, সমালোচনা করছেন, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন এবং নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে অনেকেই অশিক্ষকসুলভ শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করছেন।

দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে কিছু শিক্ষক একটা মানববন্ধনও করেছেন। আন্দোলনকারীরা এই বলে নিজে গরম হচ্ছেন ও  অন্যদের গরম করার চেষ্টা করছেন যে, বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বদলির সুযোগ আছে অথচ বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির সুযোগ নেই, এটি অন্যায় ও অবিচার। আমরা অনেক দিন ধরে অনেক দূরে পড়ে আছি। তাই এখই বদলির ব্যবস্থা করতে হবে।  কিন্তু তারা কেউ বলছেন না বা বলতে পারছেন না যে, আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিদ্যমান অবস্থায় এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী বদলির বিধানটি কেমন হবে? যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ আলাদা, পরিচালনা কমিটি আলাদা, কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠান অংশের আর্থিক-অনার্থিক সুবিধাদি আলাদা, নিয়োগের শর্ত কম/বেশি আলাদা এবং নিয়োগকর্তাও আলাদা। এমনকি সর্বশেষ ব্যবস্থায় এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে সিলেকশন পেয়ে যারা শিক্ষক হয়েছেন তাদের নিয়োগও দিয়েছে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; সরকার বা এনটিআরসিএ নয়। এমপিওভুক্তরাও যারা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সমপদে বা উচ্চ পদে গিয়েছেন/যাচ্ছেন তারাও নতুন করে আবেদন করে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগপত্র নিয়ে যোগদান করেছেন। এই ব্যবস্থাটি আসলে বদলির বিকল্প। সরাসরি বদলির সুযোগ না থাকলেও এভাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একজন শিক্ষক/কর্মচারী/প্রতিষ্ঠান প্রধান এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ আছে। বিদ্যমান এই নিয়মে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে আবেদন করে নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করে অধিক পছন্দের প্রতিষ্ঠানে গিয়েছেন অনেক এমপিওভুক্ত শিক্ষক। গতবার আমাদের প্রতিষ্ঠানে এসেও যোগদান করেছেন এমন দুজন শিক্ষক। এতে তুলনামূলক অধিক যোগ্যরা ভালো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকছে।  আর যারা এই নিয়মে প্রতিযোগিতা করে প্রতিষ্ঠান বদল করতে চাচ্ছেন না সম্ভবত তারাই সরাসরি বদলির সুযোগ দাবি করছেন।

সরকারি কিছু বিধি বিধান মেনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদাবনতি, শাস্তি, বরখাস্ত ইত্যাদি কার্যকর করার ক্ষমতা কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিচালনা কমিটির হাতেই। অপরদিকে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগকর্তা সরকার। সকল প্রতিষ্ঠানের বেতন, ভাতা, সিপিএফ ও অন্যান্য সুবিধা সমান। পদোন্নতি ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়। সরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকার। তাই সেখানে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি কার্যকর করা সম্ভব। ব্যাংক বিমা ও অন্যান্য বেসরকারি/প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও নিয়মটা এমনই। একই ব্যাংকের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় বদলি হওয়া যায়। কিন্তু এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে যেতে চাইলে নতুন করে নিয়োগ নিতে হয়। এইসব বেসরকারি/প্রাইভেট ব্যাংক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই প্রতিটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পৃথক বা স্বতন্ত্র। তাই এখানে বদলি কার্যকর করা সহজ নয়।

আগেই বলেছি, বেসরকারি একেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তহবিল ও সুযোগ সুবিধা একেক রকম। এখানে শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির সুযোগ দেয়া হলে কেউ কেউ যেমন নিজের এলাকায় অবস্থিত ভালো প্রতিষ্ঠানে যেতে চাইবেন তেমনি অধিকাংশই অধিক সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান ও শহরে/অনুকূলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তদবির করবেন। একটা পদের বিপরীতে আবেদন আসবে হাজারটা। কোন বিবেচনায় গ্রহণ করা হবে কার একটি আবেদন, আর বাদ দেয়া হবে বাকি সব? তখন হয়তো সেখানে হবে হাজারো অনিয়ম। শুরু হবে ধাক্কাধাক্কি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। আবার কাউকে ফোর্স ট্রান্সফার দেয়া হলে সে দায়ের করবে রিট। বলবে, আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছি সেই প্রতিষ্ঠানেই থাকবো। নিয়োগের সময় আমাকে বদলি করা হবে এমন কোনো শর্ত বা সম্ভাবনা ছিল না। 

এসব বাস্তব অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির জন্য সর্বজন গৃহীত একটি সুষ্ঠু বিধিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। অবশ্য যখন সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন, ভাতা, বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরকার প্রদান করবে এবং পরিচালনা কমিটির ক্ষমতা আরও হ্রাস করবে তখন বিষয়টি এতো বেশি জটিল থাকবে না। তবে বর্তমান/বিদ্যমান অবস্থায়ও সামান্য কিছু নিয়ম প্রনয়ণ করে অতি সহজেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মিউচুয়াল ট্রান্সফারের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।  

মো. রহমত উল্লাহ্ : শিক্ষাবিদ এবং  অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056700706481934