বেসরকারি শিক্ষকের কষ্টের ডায়েরি থেকে

মুজম্মিল আলী |

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কষ্ট নিয়ে আর কত লিখে যেতে হবে? অনেকদিন হয় তাদের কষ্টের কোনো সীমা খুঁজে পাই না৷ সীমাহীন কষ্টের মাঝে তাদের বসবাস৷ চারপাশে কষ্টের দেয়াল৷ শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে আজ ক'বছর ধরে নিয়মিত লিখি৷ প্রতিনিয়ত মনে হয় তাদের কষ্টের সিকি আনাও আজ পর্যন্ত বলা হয়নি৷ এত কষ্ট নিয়ে যারা শিক্ষকতা করেন তারা নিঃসন্দেহে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক৷ তাদের সাথে পৃথিবীর আর কোনো শিক্ষকের তুলনা হয় না৷

আজ তাদের অন্য দু' চারটে কষ্টের কথা লিখে জানাতে চাই৷ সে কষ্টগুলো কেবল তাদের একার নয়৷ আমাদের সবার৷ এর জন্য যদি কোনো লজ্জা হয়ে থাকে সে শুধু তাদের নয়-আমাদেরও৷ স্বাধীনতা অর্জনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আমরা আজো তাদের কষ্টগুলো লাঘব করতে পারিনি৷ সে ব্যর্থতা তাদের নয়-আমাদের৷ তারা তাদের কষ্টগুলো দূর করার জন্য মাঝে মাঝে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে থাকেন৷ আমরা তা শুনেও শুনি না৷ না শোনার ভান করে থাকি৷ এতে তাদের কষ্ট বেড়ে আরো বড় হয় বটে কিন্তু ক্ষতি হয় আমাদের৷ সে ক্ষতি অপূরণীয়৷ কোনোদিন পূরণ হবার নয়৷ শিক্ষার পথে এগুলো বড় অন্তরায়৷ মুখ্য কারণ৷ আমাদের শিক্ষা নিয়ে নানাজনের নানা কথা৷ হবে না কেন? বেসরকারি শিক্ষকদের কষ্টগুলো যতদিন দূর হবে না আমাদের শিক্ষা নিয়ে ততদিন এরকম কানাঘুষা চলতেই থাকবে৷

বেসরকারি শিক্ষকের বেতনই বা ক' টাকা? তা থেকে তাদের ইনকাম ট্যাক্স দেয়া লাগে৷ বড় কষ্টের কথা৷ এক রকম জোর করে এ ট্যাক্স আদায় করা হয়৷ তারা যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে তাদের পরিবারের খরচ চালিয়ে আর কিছু অবশেষ থাকে না৷ অধিকন্তু বছর শেষে তাদের আয় ব্যয়ে ঘাটতি থাকে৷ এ অবস্থায় তারা কী করে ইনকাম ট্যাক্সের আওতায় পড়েন সেটি বোধগম্য নয়৷ বেসরকারি শিক্ষকদের এ কষ্টটুকু বলার জায়গা নেই৷ শোনবার মানুষও একেবারে কম৷

আরেকটা বিষয় অনেকে জানেন না৷ জানার কথাও নয়৷ প্রতি মাসের বেতন বিলের সাথে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অঙ্গীকারনামা দেয়া লাগে৷ এটি সাথে না দিলে ব্যাংকের লোকজন বিল জমা রাখেন না৷ আবার প্রতি বছর জুনের বিলের সাথে কমিটি ও শিক্ষক-কর্মচারীদের আলাদা আলাদা স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারপত্র দেয়া লাগে৷ কত অপমান ও বেইজ্জতির বিষয়! এ রকম অঙ্গীকারনামা দিয়ে দুনিয়ার কোথাও শিক্ষকেরা বেতন নেন বলে জানা নেই৷ শিক্ষক কেন শ্রমিকদের কাছ থেকেও মনে হয় কেউ কোথাও অঙ্গীকারপত্র নিয়ে বেতন ছাড় করে না৷ 

শিক্ষকদের ছোট করে রাখার এরকম হীনমন্যতা সত্যি কষ্টের বিষয় ছাড়া কিছু নয়৷ অন্য কোনো পেশায় এরকম অঙ্গীকার দেবার রেওয়াজ আছে বলে জানা নেই৷ পরিশ্রম করে টাকা পেতে কিসের আবার অঙ্গীকার? শিক্ষকদের ইনকাম ট্যাক্সের আওতা থেকে বাদ দেয়া দরকার৷ সেই সাথে অঙ্গীকার নিয়ে বেতন দেবার মানসিকতা ত্যাগ করা আবশ্যক৷

যারা হাজার কোটি টাকার মালিক তারা ইনকাম ট্যাক্স দেবেন৷ যারা ব্যবসা করেন তারা দেবেন৷ যারা বছরে খেয়ে দেয়ে হাজার হাজার টাকা সঞ্চয় করেন তারা ট্যাক্স দেবেন৷ এটাই নিয়ম বলে জানি৷ বেসরকারি শিক্ষকের বেতনের টাকায় সংসার চলে না৷ নুন আনতে পান্তা ফুরায়৷ পেটে খেলে পিঠে সয়৷ এ অবস্থায় শিক্ষকদের জন্য ইনকাম ট্যাক্স মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের সমান৷

দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়- বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে৷ কোনো হদিস মিলছে না৷ খুব টেনশন লাগছে৷ দুশ্চিন্তার কথা৷ কেউ কেউ তিন চার মেয়াদে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, সচিব হচ্ছেন৷ তারা বাদে আর কি লোক নেই? বারবার এদের দিতে হবে কেন? এ কারণে তো এসব হচ্ছে৷ 

আমলাদের এজেন্ডা এরাই বাস্তবায়ন করে৷ সেদিন দেখলাম কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব বলছেন-শিক্ষক কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ তহবিলে নাকি অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের শর্তে অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয়েছে৷ কী সেই অন্যান্য সুবিধা? যদি ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এবং বৈশাখী ভাতার কথা বুঝিয়ে থাকেন তবে তার কথাটি সঠিক নয়৷ আমরা জানি মাদার অব হিউম্যানিটি শেখ হাসিনা বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের কোনো শর্ত ছাড়াই এগুলো দিয়েছেন৷ তাহলে শর্তের কথা আসে কেন? আর কোন শর্ত থাকলে পরিষ্কার করে বলা দরকার৷ 

কারো বদান্যতা নয়, শিক্ষক-কর্মচারীগণ যে সকল সুযোগ সুবিধা অর্জন করেছেন সে সব তাদের ন্যায্য পাওনা এবং যে সব পাওয়ার দাবি করেন সে সব তাদের ন্যায়সঙ্গত হোক৷ এ নিয়ে কারো দালালির অবকাশ নেই৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে বিতর্কিত করার কোনো সুযোগ নেই৷ তার এ কথার নিন্দা জানাই৷ যারা বিভিন্ন সময়ে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য-সচিব হয়েছেন তাদের যাবতীয় কাজ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন৷ দুদক নামের সংস্থাটি কি এসব দেখে না? প্রাইমারি স্কুলে তারা দুর্নীতি খোঁজে৷ এসব জায়গায় যায় না কেন? দুই মেয়াদের বেশি যাতে কেউ এসব পদে আসতে না পারেন সে ব্যবস্থাটি করা দরকার। 

অতিরিক্ত কর্তনের আদশ বাতিল করা তো দরকারই সে সঙ্গে অবসর ও কল্যাণ তহবিলের চাঁদা কর্তনও বন্ধ করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা চালু করা অপরিহার্য৷ তা না হলে অসন্তোষ বাড়তেই থাকবে৷ সিলেটি ভাষায় খুব কমন একটি প্রবাদ বাক্য আছে- বাড়ে বন পুড়ে৷ কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি কাম্য নয়৷                                                           
 

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052859783172607