বেসরকারি শিক্ষকের কষ্টের বয়ান

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন নিয়ে আমার অন্য এক লেখার শিরোনাম ছিল- 'অতিরিক্ত কর্তন ও কাঙ্গালের ধন চুরি'। সেখানে 'কাঙ্গাল' বলে সেসব লোকের প্রতি ইঙ্গিত করতে চেয়েছি, যারা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সামান্য ক' টাকা বেতনের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। যারা শিক্ষকদের বেতনের ওপর ইনকাম ট্যাক্স বসায়। অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা পাবার পর এসব কাঙ্গালের বুকের ভেতর হিংসার যে আগুন লেগেছিল অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন কার্যকর ও বাস্তবায়ন করে সে আগুন নেভাতে পেরে এখন তাদের মনে স্বর্গের (!) শান্তি ও স্বস্তি দু'টোই বিরাজ করছে। শিক্ষা ও শিক্ষক বিদ্বেষী এই আমলাগুলো যতদিন থাকবে ততদিন বেসরকারি শিক্ষকদের 'বে' উপসর্গের কবল থেকে রেহাই নেই।

বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে একতার দারুণ অভাব। নেতাদের মধ্যে বেশির ভাগের মনোভাব 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' এর মতো। সাধারণ শিক্ষকদের বেশির ভাগের অবস্থা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'। ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে সেখানে তাদের সমিতি। এত সমিতি আর কারো নেই। এই অবস্থায় তাদের দুর্দিন ও দুর্দশা ঘোচাতে কে এগিয়ে আসবে? ইসলাম ধর্মের ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনে বর্ণিত আছে, 'তোমরা তোমাদের রজ্জুকে শক্ত করে আকড়ে ধরো'। আরও বলা হয়েছে, 'যে জাতি নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না'।

বেসরকারি শিক্ষকদের এখন একটাই কমন ইস্যু- 'জাতীয়করণ'। এই কমন ইস্যুতেও কেন তারা এক হতে পারেন না সেটিই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিক্সা ড্রাইভার কিংবা সিএনজি ড্রাইভাররা পর্যন্ত যেখানে মুহূর্তের মধ্যে এক হয়ে যে কোনো দাবি আদায় করতে পারে সেখানে শিক্ষকদের এক হতে না পারার কারণটি খুঁজে পাই না।

শিক্ষা থেকে 'বেসরকারি' শব্দটি মুছে দেবার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার বিষয়টি অনেক আগেই স্পষ্ট। যেদিন সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানের কাছে তিনি সব স্কুল-কলেজ একসাথে জাতীয়করণের হিসাব জানতে চেয়েছেন সে দিনই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ আজ অবধি তা কাজে লাগাতে পারেনি। একজন প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে কাজে লাগাতে না পেরে বার বার আমলাদের কাছে হেনস্তা হওয়া তাদের জন্য সত্যি লজ্জার বিষয় বটে। এ থেকে তাদের পরিত্রাণের পথ নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। একজন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে তাদের খুঁজে বের করতে হবে যার নেতৃত্বে জাতীয়করণ আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে। আবুল কালাম আজাদের বলিষ্ট নেতৃত্বের কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জ্বলা পোড়া বাংলাদেশে আমাদের জাতির জনক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তনয়া মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণের জন্য হয়ত বা সে মাপের একজন নেতাই খুঁজছেন।

আজকের লেখার শিরোনামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কবিতার চরণগুলো শুরুতেই উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত একটি কবিতার এ চরণগুলো প্রায় সবার জানা আছে। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবি রবি ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার প্রতি শ্বাশত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করে চরণ দু'টি এখানে উদ্ধৃত করতে চাই- “এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।”

দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের আদেশ জারি হবার পর কবিগুরুর কবিতার এ চরণগুলো বার বার মনে পড়তে থাকে। মাঝখানে কয়দিন তেমন মনে পড়েনি। এপ্রিল মাসের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে রাখার পর আবার কবিতার লাইনগুলো মনে পড়তে শুরু করেছে। আদেশটি জারির সময় যাদের কাঙ্গাল বলে ভেবেছি আজ আদেশটি কার্যকর করার পর তাদের লোভী নিকৃষ্ট রাজার হীনমন্যতার সাথে তুলনা করতে মন চায়।

পৃথিবীতে নিকৃষ্ট বিত্তশালী লোকজনের ধনসম্পদের প্রতি লোভ দুর্নিবার ও অসীম। তাদের এই চাওয়াটুকু নিবৃত করতে এরা অসহায় গরীব মানুষের দিকে ভয়াল থাবা প্রসারিত করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করে না। যাদের অঢেল সম্পদ তারা আরও বেশি চায়। আরও বেশি সম্পদের মালিক হবার জন্য দরিদ্র মানুষের শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নিতেও দ্বিধাবোধ করে না। ধনিকের ঐশ্বর্যের প্রতি গরীবের লোভ না থাকলেও ধনীর লোভ তাদের দিনে দিনে সম্বলহীন করে তোলে।

পবিত্র রমজান মাসে দেশের আপামর বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা মনে অন্য এক কষ্ট ধারণ করেছেন। সেটি জোর জবরদস্তি করে তাদের কাছ থেকে অবসর ও কল্যাণ তহবিলের নামে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করে রাখা। কারো অনিচ্ছায় জোর করে তার টাকা থেকে কেটে রাখা এক রকম জুলুম ছাড়া কিছু নয়। এটি স্পষ্ট এক রকম অত্যাচার। কোনো শ্রমিকের টাকা থেকেও তার অমতে কেটে রাখার নিয়ম দুনিয়ার আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। শিক্ষকদের সাথে যারা এ রকম অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমবাজি করে তাদের বিচার হওয়া চাই। বলে কয়ে কারো কাছ থেকে দশ-পাঁচ টাকা নেয়া যায়। তাই বলে জোর করে ৪ শতাংশ?
 
বেসরকারি কোনো শিক্ষক-কর্মচারী কথিত রাজনীতি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন না। আজকাল টাকার কুমির হতে হলে কথিত রাজনীতি করা লাগে। ব্যবসায়ী হতে হয়। শিক্ষকতা করে কোনো মতে দু'মুঠো ভাতের সংস্থান করা যায়। এর বেশি কিছু নয়। এই অবস্থায় তাদের ওপর ইনকাম ট্যাক্স ও অতিরিক্ত কর্তন মরার উপর খাঁড়ার ঘা'র সমান।

এখন রমজান মাস। এ মাসে বাড়তি খরচের শেষ নেই। সামনে ঈদ। সিকি আনা বোনাস ঈদের আনন্দ সিকি ভাগে নামিয়ে আনে। এ কষ্ট কেবল বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের। এর মাঝে চলতি মাসে বেতন হ্রাস পাওয়া বিলে স্বাক্ষর করতে গিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী মনের ভেতর অন্য রকম কষ্ট অনুভব করেছেন। এ কষ্টের দহনে অত্যাচারীর খড়গ একদিন জ্বলে পুড়ে ছারখার হবে। সেদিন শিক্ষার আলোয় জ্যোতির্ময় হবে প্রিয় বাংলাদেশ। শিক্ষক সমাজের মনে কোনো কষ্ট থাকবে না সেদিন। তর তর করে সবার আগে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ।

মে মাসে মহান ‘মে দিবস’ বঞ্চিত মানুষজনকে এক হয়ে দাঁড়াবার শিক্ষা দেয়। এ শিক্ষাটি কোনদিন জানি প্রতিফলিত হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনে। তাদের সব কষ্ট অবসানের এই একটিই পথ। অন্তত আমি আর কোনো পথ খুঁজে পাই না।

 

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032100677490234