বলছি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাদানের কর্মে নিয়োজিত বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রায় তেইশ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় কর্মরত ভাগ্যাহত প্রায় পাঁচ লক্ষ অধ্যক্ষ, সুপার, প্রফেসর, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও কর্মচারীর কথা। বলতে গেলে সরকারি এমন কোন সুযোগ - সুবিধা নেই যার থেকে জাতি গঠনের এই কারিগররা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক বঞ্চিত নন। তাঁদের চিকিৎসা ও বাড়ি ভাড়া বাবদ যা দেওয়া হয় প্রকারান্তরে সেটা তাদের উপহাস করারই সামিল! যদিও মাননীয় মন্ত্রীর ভাষায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চিকিৎসাভাতা পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে! পাঁচ গুণে কত টাকা সেটা অবশ্য উনি বলেননি।
এছাড়া প্রতি বছর তাঁরা ধুমধামের সাথে সরকার নির্দেশিত পথেই পহেলা বৈশাখ পালন করলেও তাদের বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয় না। কিন্তু কেন, এটা কি সরকারের উদাসীনতা, অজ্ঞতা নাকি অবহেলা ? এতকাল ধরে ৮ বছর পর একটা স্কেল দেওয়ার বিধান থাকলেও বর্তমান বিধিতে তাও বন্ধ। বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি করা এটা কি কোন অপরাধের মধ্যে পড়ে? সুধী সমাজ জবাব দেবেন কি ?
সরকার নির্ধারিত পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট নিয়ে হ্যাঁ অথবা না কোন কথাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে না।
উৎসব বোনাস স্কেলের পচিশ শতাংশ। এটা কি জাতির জন্য লজ্জা নয় ?
জাতি গড়ার কারিগর এই শিক্ষক - কর্মচারীদের পেটে আজ পর্যাপ্ত ভাত নেই, মাথায় তেল নেই, বাজারের সর্ব নিম্নদরের পোশাক তাঁদের পরিধানে, রোগে ভালো চিকিৎসক দেখানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই, বাসস্থান জরাজীর্ণ।
বিনোদন বলতে বউয়ের ঝাড়ি, স্বামীর বকাবকি, সন্তানের চোখের জল, পিতা-মাতার দীর্ঘশ্বাস, পাড়া- প্রতিবেশীর টিটকারি, আত্নীয় -স্বজনের অযাচিত উপদেশ, দোকানদারের চোখ রাঙানি ইত্যাদি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
ন্যায্য সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায় আজ শিক্ষকরা সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের পাঠদান বাদ দিয়ে কখনও কখনও দেশের প্রতিটি রাজপথে ভিক্ষার থালা হাতে, কখনও প্রেসক্লাবের সামনে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, কখনও প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যানের বারান্দায় হাত জোড় করে বসে বসে বিনিদ্র দিবস - রজনী পার করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।
যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও লেখাপড়া করেছেন বেসরকারি স্কুল, কলেজে। তাঁর পিতা আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পড়ালেখা করছেন বেসরকারি স্কুল, কলেজে। আধুনিক ফরিদপুরের রূপকার স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন আমার বেসরকারি স্কুল ঈশান ইন্টিটিউশনের ছাত্র। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, রাজবাড়ীর কৃতী সন্তান বর্তমান মাদ্রাসার দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী , ফরিদপুরের আরেক কৃতী সন্তান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাননীয় মহাপরিচালক মাহাবুবুর রহমানও বেসরকারি স্কুল, কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। এরকম লক্ষ লক্ষ তারকা, মহামানব এবং সে সাথে কোটি কোটি শিক্ষিত নাগরিক তৈরির কারিগর বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক -কর্মচারীগণ তাদের তারকা সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন ভালো কিছু প্রতিদান পাবেন আশায়।
আজ চাকরি শেষে প্রায় পঁচাত্তর হাজার শিক্ষক -কর্মচারী এক থেকে পাঁচ বছর তাঁদের পেনশনের টাকা পাবার অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো বসে আছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের ভাগ্যের শিকে আর ছিড়ছে না। অনেকেই এ টাকার মুখ না দেখেই চোখ ভরা জল, বুক ভরা ব্যথা, দীর্ঘশ্বাস আর রোগ - শোকে ভালো চিকিৎসা করাতে না পেরে অসময়েই চিরবিদায় নিচ্ছেন পৃথিবী থেকে। এ মৃত্যুর দায় কার ? এ জাতীয় মৃত্য কি খুনের পর্যায়ে পড়ে না ? মানবাধিকারের কর্মকর্তা-কর্মীরা কি বলেন ?
অন্যদিকে "ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল মারার গোসাই"- অবসর কল্যাণ বোর্ড ফান্ডে মাসিক আরো চার শতাংশ টাকা কেটে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। যার সুফল টাকার মালিক পাবে না।
বিশ্বের ব্যয়বহুল সেতুর অন্যতম 'পদ্মা' সেতুর দুঃসাহসী প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একমাত্র আপনি, হ্যাঁ একমাত্র আপনিই পারেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করণের মাধ্যমে তাঁদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটিয়ে, এই অভাগা শিক্ষকদের, সমাজে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার সুযোগ করে দিতে । শুধু তাই নয় এই ৯৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার লজ্জার হাত থেকেও বাঁচতে পারবে। তাদের অভিভাবকরাও মাথা উঁচু করে বলতে পারবে আমার সন্তান সরকারি স্কুলে পড়া -লেখা করে। সরকারি- বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা জাতীর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে। এই বিভেদের দেওয়াল ভেঙ্গে জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ একমাত্র আপনিই দিতে পারেন। কেননা আপনার শরীরে আছে জাতির পিতার রক্ত।
অভিভাবকরা সন্তান জন্ম দেন লালন- পালন করেন, ভালো মানুষ করে গড়ে তোলেন এক সময় এদের কাছে কিছু পাবেন আশা করে। আজকে আমরা যদি আমাদের তারকা সন্তানদের কাছে কিছু আশা করি সেটা কি অন্যায় হবে ? যদি তেমনটা হয় তাহলে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ক্ষমা কর দেবেন। দোয়া করি আপনারা সবাই ভালো থাকুন। আমরা আর কটা বসন্তই বা পাব ? কোন না কোন ভাবে সেগুলোও কাটাতে পারব ! হয়ত একটু কষ্ট হবে ! হোক না । বিগত কত বসন্তই তো খেয়ে, না খেয়ে কত কষ্টে কাটিয়েছি। শরৎ চন্দ্রের অন্নদা দিদির মতো "দুঃখ সহিয়া সহিয়া আজ কোন দুঃখই আর তেমন একটা কষ্ট দেয় না।" শুধু আফসোস তাহলে কি আমরা ভুল করেছিলাম ? দোয়া করি আপনারা সবাই ভালো থাকুন।
লেখক: শিবপ্রসাদ দাস, সহকারী প্রধান শিক্ষক, ঈশান ইনস্টিটিউশন, ঈশান গোপালপুর, ফরিদপুর।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়]