বেসরকারী কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না

বিভাষ বাড়ৈ |

ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট তৈরি হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশের কারণে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না সারাদেশের কোন বেসরকারী কলেজে। ফলে ভারপ্রাপ্তদের ভারে বেসরকারী কলেজ রীতিমতো আক্রান্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে চলছে পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ ছাড়া। প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনতে অধ্যক্ষ নিয়োগের আশায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের শরণাপন্ন হচ্ছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই মুহূর্তে প্রায় ১১শ’ কলেজ চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। ঢাকা বোর্ডে অধ্যক্ষ নেই ২০০ কলেজে। খোদ ঢাকা মহানগরীর ৬২ কলেজেই নেই অধ্যক্ষ। তালিকায় আছে দেশের নামী-দামী প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই।

জানা গেছে, সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে ইতোমধ্যেই নতুন শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনির সহায়তা চেয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। তারা শিক্ষামন্ত্রীকে বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বের এক স্থগিতাদেশের কারণে উদ্যোগ নিয়েও অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারছেন না তারা। মাসের পর মাস কখনও বছরের পর বছর ধরে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, সঙ্কট তৈরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায়। তারা মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাতিল করে দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগের পথ খুলে দেয়ার আবেদন করেছেন। ঢাকা মহানগরীর একাধিক নামী প্রতিষ্ঠানও সঙ্কটে পড়ে মন্ত্রণালয়ের বরাবর লিখিত আবেদন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারী আদেশে সকল প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ নিয়োগ এই মুহূর্তে বন্ধ। মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেছেন, এখন অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়ার কোন সুযোগ নেই কোন প্রতিষ্ঠানেই। আমরা বিষয়টি দেখছি। গত বছর ২৮ আগস্ট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ পদে এবং ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ পদেও নিয়োগের সকল কার্যক্রম স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, অধ্যক্ষ নিয়োগে নতুন কোন পদক্ষেপের আশায় মন্ত্রণালয় বিষয়টি সময় নিলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোন অগ্রগতি নেই। উল্টো আদেশের কারণে কলেজগুলো উদ্যোগী হলেও শেষ পর্যন্ত নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এমনকি প্রার্থীদের আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করেও শেষ পর্যন্ত শিক্ষা অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞায় স্থগিত করতে বাধ্য হয় পুরো প্রক্রিয়া। অথচ প্রতিষ্ঠানটিতে বছরের পর বছর ধরে চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। গত সাত বছরে নানা অসন্তোষের কারণে কয়েকজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অপসারণ করতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ভিকারুননিসার মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এবার নতুন মন্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে সঙ্কটের সুরাহা চান।

কিন্তু সঙ্কট এখন কত প্রতিষ্ঠানে? দেশের নামী প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে সেই ঢাকা মহানগরীরই অবস্থা কি? এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে উদ্বেগজনক চিত্রই। জানা গেছে, গত কয়েক মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসা কলেজ কর্তৃপক্ষের চাপে সক্রিয় হন কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা বোর্ডকে পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠাতে বলা হয়। এরপর বোর্ডগুলো তালিকা প্রস্তুত করা শুরু করে। শিক্ষা বোর্ডগুলোতে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সকল বোর্ডেই শতাধিক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে নেই অধ্যক্ষ। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চালাতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠান।

হিসাব বলছে, ১১শ’রও বেশি বেসরকারী কলেজে এ মুহূর্তে আছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে মামলা হামলার প্রেক্ষাপটে কেউ-ই দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। তবে সঙ্কট সবচেয়ে বেশি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উত্তরভাগে এমন প্রতিষ্ঠান আছে ৩৫টি। দক্ষিণে আছে ২৭টি। ফলে নামী-দামী প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই এক অবস্থা।

তালিকায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ৬২, ঢাকা জেলায় ৮, নারায়ণগঞ্জে ১১, গাজীপুরে ২১, ফরিদপুরে ৬, মুন্সিগঞ্জে ৩, টাঙ্গাইলে ৩২, কিশোরগঞ্জে ১৮, রাজবাড়ীতে ৯, নরসিংদীতে ১৭, মাদারীপুরে ২, মানিকগঞ্জে ৩, গোপালগঞ্জে ৬ ও শরীয়তপুরে ২টি প্রতিষ্ঠান চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। এমন অবস্থা চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, যাশোর, দিনাজপুরসহ প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই।

ঢাকা মহানগরীর ৬২ কলেজ চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে। এর মধ্যে মহানগর উত্তরের ৩৫ ও দক্ষিণের ২৭টি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২৭টি প্রতিষ্ঠান হলো- হাজী আব্দুল আউয়াল কলেজ, ইস্পাহানি গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মনিজা রহমান গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ঢাকা পাবলিক কলেজ, কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ, এইচআর মেমোরিয়াল কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও সরকারী কলোনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নবকুমার ইনস্টিটিউশন এ্যান্ড ড. শহিদুল্লাহ কলেজ, ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন।

আছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মান্নান হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও আইডিয়াল কলেজ, রোকেয়া আহসান কলেজ, শ্যামপুর বহুমুখী হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, রংমালা আকবর মহিলা কলেজ, এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ, ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সিদ্বেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সাফির আইডিয়াল কলেজ, হাজী সেলিম ডিগ্রী কলেজ, দনিয়া কলেজ, মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ ও মহানগর আইডিয়াল কলেজ।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চলা ঢাকা মহানগর উত্তরের ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো- শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজ, মিরপুর বাঙলা হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, বাড্ডা আলাতুনেচ্ছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা পাবলিক কলেজ, ঢাকা বয়েজ কলেজ, উত্তরা টাউন কলেজ, আমজাদ আইডিয়াল কলেজ, রামপুরা একরামুনেছা কলেজ, টাচস্টোন কলেজ, আকিজ ফাউন্ডেশন কলেজ, এমিনেন্স কলেজ, কুর্মিটোলা হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট, পল্লবী কলেজ, উত্তরা আইডিয়াল কমার্স কলেজ, শেরেবাংলা নগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

আছে উত্তরা হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, আইপিএইচ স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উত্তরা সিটি কলেজ, সাঁতারকুল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, কামারপারা স্কুল এ্যান্ড কলেজ, কুইন মেরি কলেজ, হাজী কলেজ, নওয়াব হাবীবুল্লাহ মডেল হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উত্তরা মডেল কলেজ, উত্তরা গার্লস হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, গ্লোরি কলেজ, কুইন্স কলেজ, আহসানিয়া মিশন কলেজ, সরোজ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, বনফুল আদিবাসী গ্রিন হার্ট কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ এবং উত্তরা কমার্স কলেজ।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক সাহেদুল খবীর চৌধুরী বলছিলেন, আসলে সারাদেশেই কম বেশি এই সমস্যা। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাঠিয়েছি। এদিকে রবিবার নিজেদের প্রতিষ্ঠানের কথা তুলে ধরতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের গবর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদারসহ সদস্যরা।

গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থগিতাদেশের কারণে উদ্যোগ নিয়েও অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারছেন না তারা। বছরের পর বছর ধরে ভারপ্রাপ্তদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, সঙ্কট তৈরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায়। তারা মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাতিল করে দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগের পথ খুলে দেয়ার আবেদন করেছেন। মন্ত্রণালয় বিষয়টি দ্রুত দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান সভাপতি।

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056447982788086