বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সমাধান হিসেবে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কার্যকারিতা

খায়রুল কবির নিশান |

শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর কারণ বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ বেড়েছে। এই তাপমাত্রা যাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না যায় তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে ‘প্যারিস এগ্রিমেন্ট’-এ। তবুও উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখতে পারছে না। যার কারণে তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে এবং দুই মরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও সমানতালে বেড়ে চলছে।

বেড়ে চলা এই তাপমাত্রাকে রোধ করতে ক্ষণস্থায়ী একটি প্রক্রিয়া হল জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে জলবায়ুর কিছু উপাদানের (মেঘ, বায়ুমণ্ডল, পানি, সূর্যের আলো ইত্যাদি) সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। একটি উদাহরণ দিলে জিনিসটা সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হবে। আমাদের পৃথিবীর সব শক্তির উৎস হলো সূর্যের আলো। এই আলো বিকিরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসে, যার কারণে পৃথিবী তাপশক্তি পায়। কিন্তু প্রায় ৩০ শতাংশ সূর্যের আলো মেঘ বা বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন কণার কারণে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় মহাশূন্যে। বাকি ৭০ শতাংশ পৃথিবীতে পৌঁছায়। কিন্তু বিভিন্ন গ্যাস (যেমন কার্বন-ডাইঅক্সাইড) ওজন স্তরের ক্ষতি করায় এখন সূর্যের তাপ (আলো) কম পরিমাণে ফেরত যায়, ফলে সেটা বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই অবস্থান করে, তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

সূর্যের আলো কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নে একটি বড় ভূমিকা রাখে। কারণ সকল তাপশক্তির উৎস এটাই। এখন আমরা যদি সূর্যের আলো আরও কম পরিমাণে প্রবেশ করতে দেই তাহলে তো পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় না! এর জন্য আকাশে এরোসল (এক ধরনের কণা যা মেঘ জমতে সাহায্য করে) ছড়িয়ে দেয়া যাতে আরও বেশি মেঘ জমে। ফলস্বরূপ সূর্যের আলো বেশি প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যাবে, ফলে বায়ুমণ্ডলে তাপ কম আসবে।

এত গেলো একটি উদাহর। এরকম আরও অনেক অনেক প্রক্রিয়া আছে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিংযে ব্যবহৃত হয়। 

বর্তমানে বড় ধরনের কিছু জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট চলমান অবস্থায় আছে। যেমন- Climeworks নামক একটি কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আটকিয়ে সেটা পুনরায় বিক্রয় করে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে হাভার্ড ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী পরীক্ষামূলকভাবে বায়ুমণ্ডলে এরোসল ছড়িয়ে দেয় স্বল্প আকারে, এই পদ্ধতির নির্ভরতা পরীক্ষা করতে। 

সমুদ্রে আয়রন (একটি মৌল) ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা বায়ুমন্ডল থেকে আরও বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেয়। আরেকটি মজার উদাহরণ হলো- মহাশূন্যে অনেকগুলো ছোট ছোট আয়না স্থাপণ করে দেয়া যাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়, পৃথিবীতে আসতে না পারে, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কম থাকে। 

মরুকরণ, খরা বা অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো সমস্যার সমাধানের জন্য এই প্রক্রিয়াগুলি তৎক্ষণাৎ সমাধান হিসেবে খুবই উপযুক্ত। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই।

সমস্যা হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াগুলোর ফলাফল ভালোর চেয়ে মন্দ বেশি। উদাহরণস্বরূপ- কেউ যদি বায়ুমণ্ডলে এরোসল ছিটিয়ে দেয়, বেশি মেঘ হবে। ফলে সূর্যের আলো তো প্রবেশ কম হবেই কিন্তু এমনও হতে পারে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেশি কমে গেলো। অথবা যেসব পশুপাখি এই তাপমাত্রাতে অভ্যস্ত তারা হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে টিকে থাকতে পারবে না। উপরন্তু বেশি মেঘ মানে বেশি বৃষ্টি। এতে বন্যার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। মানে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। তার ওপর অর্থনৈতিক বোঝা তো আছেই।

জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়াগুলো প্রচুর খরচ সাপেক্ষ এবং অনেক প্রক্রিয়া কাজও করে কিনা সন্দেহ থাকে। এমন অনিশ্চিত প্রক্রিয়ায় উন্নত দেশগুলো বিনিয়োগ করতে চায় না। একেক প্রক্রিয়ায় একেক রকম খরচ, একেক রকমের অনিশ্চয়তা, ফলাফল কি ভালো হবে না উল্টো ক্ষতির দিকে যাবে তাতেও থাকে অনিশ্চয়তা। আপাতত শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়াই যথোপযুক্ত আছে বলে মনে করা হয়। সেটা হলো- বেশি বেশি কার্বন সিংক (গাছপালা, বনাঞ্চল) তৈরি করা। যত বেশি গাছপালা হবে, তত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমবে বায়ুমণ্ডল থেকে।

পরিশেষে একটি কথা বলবো। পৃথিবীটা আমাদের, টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদেরই। এনার্জি সেভিং টেকনোলজি, বনায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এগুলোই বর্তমানে যথোপযুক্ত উপায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত করতে। জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়াগুলোর ব্যবহার তখনি করা উচিত, যখন মানবজাতির কাছে আর কোনো উপায় থাকবে না জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

লেখক : খায়রুল কবির নিশান, শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0078239440917969