বৈষম্যের যন্ত্রণায় কাতর প্রাথমিক শিক্ষা

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

প্রাথমিক শিক্ষায় বিশাল বিনিয়োগ ও অর্জনের মাঝে এগিয়ে চলছে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার। তারপরেও প্রাথমিক শিক্ষা যন্ত্রণায় কাতর কেন? স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কারো কারো মনে প্রশ্নের উদয় হয়। আজও প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকরা নানা বৈষম্যে জর্জরিত। দীর্ঘ সময় আর্তনাদের পর প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর কেড়েছে। বিষয়টি যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। বৈষম্য দূর করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। 

প্রত্যাশা করি বৈষম্য দূরীকরণ যাতে শুভঙ্করের ফাঁকি না হয়। সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ পালনে ভূমিকা রেখে আসছেন। সে প্রেক্ষাপটে সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের পরের স্কেল প্রত্যাশা মোটেই অযৌক্তিক নয়। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অধিকতর মানসম্মত করার লক্ষ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করার একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এ মহৎ উদ্যোগকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য একটি মহল সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের ষড়যন্ত্র করছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে স্কেলের পরিবর্তে ভাতা প্রদান করে বিষয়টি নিরসন করলে সহকারী শিক্ষকদের মাঝে কোন ক্ষোভ সৃষ্টি হবে না। প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির দশম গ্রেড না দেওয়ায় তাদের মাঝেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের চেয়ে বেতন কম পাচ্ছেন। এ বৈষম্য নিয়ে অযথা দীর্ঘ সময় ফাইল চালাচালি বা বৈষম্য নিরসনের নামে কমিটি করে সময়ক্ষেপন করা হচ্ছে বলে শিক্ষকেরা মনে করে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত সময় সমাধান হোক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য। 

বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দিয়েছেন। একই ধারাবাহিকতায় তাঁরই সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় সরকারিকরণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দিয়েছেন। অথচ সরকারি মর্যাদা পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম ছুটি ভোগ করেও ননভ্যাকেশনাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারীদের মত দুটি অর্জিত ছুটি, লাম্পগ্রান্ড, পিআরএল পূর্ণ বেতন পায়না? সরকারি কর্মচারীরা শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পান ৩ বছর পর পর। প্রাথমিক শিক্ষকেরা পান ৪ থেকে ৫ বছর পর পর। বাৎসরিক ছুটি তালিকায় গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন রাখা হলে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও ৩ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদনের ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সরকারি কর্মচারীরা স্বাভাবিক পদোন্নতি না পেয়ে চলতি দায়িত্বে কাজ করলে দায়িত্বভাতা ১০ শতাংশ বা অনুর্ধ্ব ১৫০০ টাকা পেয়ে থাকে। যা ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বেতন স্কেলের বইয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে নির্দেশনা দেয়া আছে। অথচ প্রাথমিক বিভাগে সকল কর্মকর্তারা চলতি দায়িত্ব ভাতা পেলেও সরকারি প্রজ্ঞাপনকে তোয়াক্কা না করে কেবলমাত্র প্রাথমিকের চলতি দায়িত্বে কর্মরত প্রধান শিক্ষকদের চলতি দায়িত্ব ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যে যন্ত্রণায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুনাম তথা অস্তিত্ত্ব বিলীন হচ্ছে তা হলো প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর অভিন্ন সময়সূচি ও পাঠ্যপুস্তক। ইদানিং সারাদেশে ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংকটে অস্তিত্ব হুমকিতে।

 

সারাদেশে উপবৃত্তি, দুপুরের খাবার, অবৈতনিক শিক্ষাসহ উচ্চ শিক্ষিত, ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার। তবুও কেন সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে। ৬২৫টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫০ এর নিচে। ২৫ টির শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ এর নিচে। বিএনপি সরকারের সময়ে কিছু বিদ্যালয় বিলুপ্ত বা একীভূত করা হয়েছে। একীভূত করার পরও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়েনি বরং কমেছে। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা মহানগরীর কতিপয় বিদ্যালয় (যেমন, শান্তিবাগের টিএন্ডটি ও খিলগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) দুটিকে একীভূত করেও দীর্ঘ সময়ের শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পরিবর্তে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। 

উচ্চ শিক্ষিত, ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষক, উপবৃত্তি, টিফিনসহ আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষকদের আন্তরিকতা থাকা স্বত্ত্বেও সফলতা আসেনি। বরং সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অস্তিত্ব সংকটে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে বেসরকারি ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা এবং কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের সময়সূচির বিশাল ব্যবধান। দিনের বেশিরভাগ সময়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয় বিধায় তারা বিকাল বেলা খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ পায়না। 

অভিভাবকরা সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধা পরিহার করে, তাদের সন্তানদের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন সময়সূচি চালু করা জরুরি। বিনামূল্যে সরকারি বই বিতরণ দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ৮০ জিএসএম হোয়াইট পেপার, কভার পৃষ্ঠা হিট থার্মাল পারফেক্ট বাইন্ডিং, চার রংয়ের আকর্ষনীয় টেকসই পরিমার্জিত কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরবরাহ করা হয়। কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়সহ বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় শিশুর মেধাবিনাশকারী পুস্তকের সমাহার। এই বই তারা বাণিজ্য করার অভিপ্রায়ে শিশু শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেয়। আমাদের বেশিরভাগ অভিভাকরা মহা খুশি। তাদের সন্তান অনেক বই পড়ে, কঠিন কঠিন শব্দ, বাক্য মুখস্ত করে, একগাদা খাতায় লেখে। তাদের ধারণা, বেশি বই খাতায় তাদের সন্তান অনেক বড় শিক্ষিত হবে। এই সব বই জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে মেধা বিনাশ করে। শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত নষ্ট করে, এই উপলদ্ধিবোধ তাদের মাঝে নেই। এই প্রেক্ষাপটে সকল শিশুর অভিন্ন বই পড়ানোর ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। বেশি বেশি বই খাতার মাধ্যমে বড় পাসের জন্য সকলে মিলে ছুটছে কিন্ডারগার্টেনের দিকে। 

অপরদিকে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বহুমুখী কাজে ব্যস্ত রাখায় দুর্নামের দায় নিতে হচ্ছে, শিক্ষক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের। বছরের পর বছর শিক্ষক সংকট চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। প্রাথমিক শিক্ষা চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে। কোন অবস্থাতে বিদ্যালয় শিক্ষক সংকট কাম্য নয়। প্রতিদিন প্রতিমূহুর্ত শিক্ষার্থী পাবে শিক্ষকের সান্নিধ্য। কিছু ফাঁকিবাজ শিক্ষক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব পালন না করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে ও শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করে। যা মোটেই সহ্য করা উচিত নয়। প্রাথমিক শিক্ষার সকল বৈষম্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলাই হোক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাজ। তাই এ বিষয়ে মাননীয় প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030539035797119