ভাষা জাতিসত্তার মূল উপাদান। ভাষাই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন গড়ে তোলে। ভাষার মাধ্যমেই একটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মনোজগৎ এবং তার অগ্রগমন- সবকিছুই প্রতিফলিত হয়।
সেজন্যই ভাষার চেয়ে জাতিসত্তার শক্তিশালী আর কোনো উপাদান নেই। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, বিশেষ করে জাতিরাষ্ট্র- এই জাতিরাষ্ট্রগুলোর মূলে কাজ করেছে ভাষিক ঐক্য। অন্যান্য উপাদানও এর সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং একটি জাতির সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে গেলে ভাষাকে বাদ দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়।
ভাষার যে এই প্রভাবক ভূমিকা, এটি সারা পৃথিবীর জন্যই প্রযোজ্য। যদিও বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং বিকাশের যে ইতিহাস, সেটি ধরতে গেলে চর্যাপদের আগে আমরা সেরকম স্পষ্ট নির্দিষ্ট অবয়ব খুঁজে পাই না। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে যে আঞ্চলিক খণ্ডতার ভেতরেও বাংলার একটা রূপ প্রচলিত ছিল। এ পরিচিতির বাইরেও আঞ্চলিকতার ভেতরেও এর একটা অবয়ব আমাদের জাতিরাষ্ট্র গঠনের দিকে ধাবিত করেছিল।
আমরা যদি আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকাই- বাঙালি জাতিসত্তার যে উদ্বোধন অর্থাৎ, বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের শনাক্ত করা বা চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা- সেটি বাঙালি কবিরা চর্যাপদের মধ্যে বিধৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এভাবে কিন্তু বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে এবং ভাষা চিন্তা থেকেই বাঙালির জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ঘটেছে।
এই জাতীয়তাবোধের চেতনাই আমাদেরকে পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছে। আমরা আজ একটা ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের অধিবাসী। এটি আমাদের জন্য গৌরবের এবং আনন্দের।
১৯৭১ সালের এই পর্বে আমাদের সার্থকতা গোটা বাঙালি জাতির সামনে একটা অবারিত দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগ সেই যোগাযোগের সেতুবন্ধ অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বায়নের এই শতকে পৃথিবী এখন বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে ভাষাও পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
আমরা অনেক সময় ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হই। সবক্ষেত্রেই যে ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি কাজ করে তা কিন্তু নয়। এখানে অর্থনৈতিক শক্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। পৃথিবীতে দেখা গেছে, অনেক রাষ্ট্রই ঔপনিবেশিক জোয়ালে আবদ্ধ ছিল; কিন্তু সেই রাষ্ট্রই দেখা গেছে যে, তারা যাদের উপনিবেশ ছিল তাদের বদলে আরেকটি দেশের ভাষা শেখার জন্য চেষ্টা করছে কিংবা তাদের অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, ভাষা অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং রাজনীতি- সবকিছুই একটা পরস্পর সম্পৃক্ত বিষয় বলে পরিগণিত হচ্ছে।
আমরা ভাষা আন্দোলন করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি, পৃথিবীতে তা স্বীকৃতি পেয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু দেশে আমরা আমাদের ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে বেশকিছু উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এখনও ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতায় ভুগছি।
আমরা যদি আমাদের রাজধানী ঢাকা এবং বড় শহরগুলোর সাইনবোর্ডগুলো দেখি তবে দেখি যে, সেখানে ইংরেজির আধিপত্য। এটা একেবারে অপ্রয়োজনীয়। আমাদের রেডিও-টেলিভিশনেও অহেতুকভাবে ইংরেজি ব্যবহারকে একটা অতি আধুনিকতা রূপে জাহির করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়গুলো নিজেদের ভাষার প্রতি হীনম্মন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। আরেকটি বিষয় রোমান হরফে বাংলা লেখার ফলে আমরা আমাদের মাতৃভাষার বিশুদ্ধ ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমাদের গ্রন্থমেলা যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, প্রতিবছর যে হারে বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেই হারে শুদ্ধ ভাষাচর্চার তাগিদ সম্প্রসারিত হচ্ছে না। ফলে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের বেশির ভাগই মানসম্পন্ন হচ্ছে না- বিশেষত, ভাষার দিক থেকে। এসব বিবেচনায় আমার মনে হয়- বাংলা বানান, শুদ্ধ বাংলাচর্চার বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সুচিন্তিতভাবে অগ্রসর হওয়া দরকার। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাতে একটা সৃজনশীল সত্তায় বিকশিত হয় সে লক্ষ্যে।
ভাষার মর্যাদা যেমন আমরা লড়াই করে আদায় করেছি, তেমনি মায়ের ভাষাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করার যে কাজ, সে কাজটি জরুরিভাবে সবাই মিলে করার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা মানে জাতির মর্যাদা রক্ষা। ভাষার মর্যাদা রক্ষা মানে জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
সূত্র: যুগান্তর